অনলাইন ডেস্ক, ১৬ মে।। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের বাফেলোতে ১০ জনকে গুলি করে হত্যা এবং তিনজনকে আহত করার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে পেইটন এস গেন্ড্রন নামের এক শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী। ওই হামলার আগে তিনি অনলাইনে ১৮০ পৃষ্ঠার একটি বর্ণবিদ্বেষপূর্ণ লেখা পোস্ট করেন। ওই লেখার পুরোটাজুড়েই বারবার বোঝানো হয়েছে যে, শ্বেতাঙ্গ মার্কিনিরা অন্য বর্ণের মানুষের সংখ্যাধিক্যের কারণে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে একাধিক বন্দুক হামলা বা সহিংসতায় জড়িত বন্দুকধারীরা এই ‘রিপ্লেসমেন্ট থিওরি’ বা ‘প্রতিস্থাপন তত্ত্ব’ নামে পরিচিত বর্ণবাদী ধারণার উল্লেখ করেছেন।
ধারণাটি একসময় কট্টর ডানপন্থি অংশের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু ক্রমেই এটি যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারায় চলে আসছে। এমনকি, রাজনীতিকদের কথোপকথন এবং জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলোতেও এই বর্ণবাদী ধারণা এখন নিয়মিতই আলোচিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
চরমপন্থি এই ধারণাটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই যুক্তরাষ্ট্র ও এর বাইরে একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। ২০১৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় ইহুদিদের প্রার্থনালয় থেকে একই বছর নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে ৫১ ব্যক্তিকে হত্যার পেছনেও ওই বিশ্বাস কাজ করেছে। বাফেলোর পেইটনের মত ক্রাইস্টচার্চের খুনিও শরীরে লাগানো ক্যামেরায় ওই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও লাইভস্ট্রিম করেছিলেন।
টেক্সাসের এল পাসোতে ২০ জনের বেশি মানুষকে হত্যায় অভিযুক্ত এক ব্যক্তির ৪ পৃষ্ঠার এক ইশতেহারে বর্ণবাদী এই তত্ত্বের প্রসঙ্গ সরাসরি এসেছে। ওই লেখায় অভিযুক্ত তার হামলাকে ‘হিস্পানিকদের টেক্সাস দখলে নেওয়ার’ প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হিস্পানিক বা স্প্যানিশ ভাষাভাষী গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমেই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
তার আগের বছর পিটসবার্গের ট্রি অফ লাইফ সিনাগগে ১১ জনকে হত্যায় অভিযুক্ত বন্দুকধারীও একই বর্ণবাদী ধারণায় বিশ্বাসী। তার দৃষ্টিতে শরণার্থীদের সাহায্য করা একটি ইহুদি সংস্থার সহযোগিতাপ্রাপ্তরা হচ্ছে ‘দখলদার’।
বর্ণবাদী এই তত্ত্ব আসে ২০১০ এর দিকে, ফরাসি লেখক রেনোঁ কামুর কাছ থেকে। ‘শ্বেতাঙ্গ বিলুপ্তির আশঙ্কা’ নিয়ে লেখালেখি করে আসা এই লেখকের যুক্তি হচ্ছে, ইউরোপে আসা শরণার্থীদের বেশি সন্তান শ্বেতাঙ্গদের হুমকিতে ফেলছে।
কামু অবশ্য শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সহিংসতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তার ধারণার ওপর ভিত্তি করে হওয়া হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরবও হয়েছেন।
তবে ২০১৯ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি ‘রিপ্লেসমেন্ট থিওরির’ পক্ষেই নিজের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন।
অন্যরা শ্বেতাঙ্গদের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে, এই ধারণা কট্টর ডানদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের আলোচনার ধরনও বদলে দিচ্ছে বলে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত যত চরমপন্থি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার প্রায় ৬০ শতাংশই ঘটিয়েছে তারা, যারা ‘রিপ্লেসমেন্ট থিওরির’ মত শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী ধারণার অনুসারী।
ঘৃণা ও উগ্রবাদবিরোধী বৈশ্বিক প্রকল্পের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হেইডি বেইরিচ বলেন, ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এখন এটাই সবচেয়ে গণ-হিংসা-অনুপ্রেরণাদায়ী ধারণা। এটি অন্যসব ধারণাকে টপকে বিভিন্ন দেশের শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের ঐক্যবদ্ধ করছে’।
কয়েক দশক আগেও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নিজেদের ‘সবার সেরা’ দাবি করত তাদের গায়ের সাদা রঙের কারণে। ওই দৃষ্টিভঙ্গি এখনও আছে, কিন্তু বেশিরভাগই এখন অন্য বর্ণের মানুষদের আধিক্যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত।
২০১৭ সালে ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে এক বিক্ষোভে শ্বেত শ্রেষ্ঠত্বাদীরা স্লোগান দিয়েছিল, ‘ইহুদিরা আমাদের প্রতিস্থাপন করতে পারবে না’।
১৮ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ তরুণ পেইটন এস গেন্ড্রনের ইশতেহারেও একই দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া গেছে। ওই ইশতেহারে তিনি ‘অন্য বর্ণের হাতে প্রতিস্থাপন’ ও ‘শ্বেতাঙ্গ বিলুপ্তির’ প্রসঙ্গ সরাসরিই এনেছেন।
তার প্রচারপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় সনেনরাড বা কৃষ্ণ সূর্যর প্রতীকও স্থান পেয়েছে; নাৎসি জার্মানিতে এই প্রতীক ব্যাপক ব্যবহৃত হতো এবং এখন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও নব্য-নাৎসিরা এটি ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছে অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগ।
গেন্ড্রন জাতীয়তাবাদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং ইউরোপীয়রা নিজেরাই নিজেদেরকে ‘জাতিগতভাবে প্রতিস্থাপিত’ করার বা নিজেদের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে বলে দায় দিয়েছেন।
তিনি আমেরিকার বৈচিত্রকে ব্যাঙ্গ করেছেন; লিখেছেন, অন্য বর্ণের লোকদের উচিত পারলে ‘দেশ (যুক্তরাষ্ট্র) ছেড়ে যাওয়া’।
প্রগতিশীলদেরও ব্যাপক সমালোচনা করেছেন তিনি। বলেছেন, তারা কেবল পেরেছে ‘শ্বেতাঙ্গ শিশুদের নিজেদের ঘৃণা করা শেখাতে’।