আগরতলা, ৭ ফেব্রুয়ারী।। ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’, কবি কাজি নজরুল ইসলামের এই পংক্তি দুটি অনেক সময় অনেকে অজ্ঞানতাবশত ভুলে গেলেও তার বিপরীত চিত্রও কিন্তু আমরা এই সমাজে দেখতে পাই।
সম্প্রতি আগরতলায় এক কন্যা সন্তানের জন্মের পর তাকে যেভাবে বাইক র্যালি করে শহর পরিক্রমা করে বাড়িতে সাদরে বরণ করে নেওয়া হল তা অভূতপূর্বই বলা চলে। লিঙ্গ বৈষমা সুদীর্ঘ সময়কাল ধরে আমাদের সমাজে এক চ্যালেঞ্জ। আর্থ সামাজিক কারণে, কুসংস্কার, প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে পুত্র সন্তানের জন্য ব্যাকুলতা কখনও কখনও পরিলক্ষিত হয়।
ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ যেন অভিশাপের মত আমাদের এ বিশ্বে প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করে কন্যা ভ্রূণের হত্যা যাতে না করা যায় তার জন্য আইন প্রণয়ন করা হল, সচেতনতা সৃষ্টির কাজ শুরু হল। ২০০১ সালের জনগণনায় আমরা লক্ষ্য করলাম ভারতে প্রতি হাজার পুরুষে মহিলার সংখ্যা ৯৩৩ জন। ত্রিপুরায় সে সময় প্রতি হাজার পুরুষে নারীর সংখ্যা ছিল ৯৪৮।
২০১১ সালের জনগণনায় ভারতে লিঙ্গ হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১০০০ পুরুষে মহিলা ৯৪৩ জন। ত্রিপুরাতে লিঙ্গ হার তখন ৯৬০:১০০০ জন। এনএফএইচএস-৪ অনুসারে (২০১৫-১৬) এ রাজ্যে জন্মের সময় কন্যা শিশুর সংখ্যা প্রতি হাজার পুত্র সন্তান পিছু ছিল ৯৬৯ জন। এন এফ এইচ এস-৫ অনুসারে (২০১৯-২০) এ রাজ্যে জন্মের সময় কন্যা শিশুর সংখ্যা প্রতি হাজার পুত্র পিছু ১০২৮ জন। কন্যা সন্তানের হার বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে জনসচেতনতার প্রক্রিয়া ধারাবাহিক ভাবেই চলছে। তার সুফলও মিলছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যে কন্যা সন্তানের যত্নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রতিক কালে মলয়নগরের রবিপাড়াতে সদ্য ভূমিষ্ঠ কন্যা সন্তানের মা-বাবা, পরিবার পরিজন, স্বজন এবং এলাকাবাসী যে কান্ডটা করলেন তা রাজ্যের গন্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে বহির্রাজ্যেও। এই কন্যা সন্তানের বাবা মলয়নগরের বাসিন্দা মানিক দেবনাথ। তার বই ও স্টেশনারি দোকান।
কলেজে ২য় বর্ষের পর অর্থাভাবে আর পড়াশোনা করতে পারেননি মানিক। সাত বছর আগে বিয়ে করেন মাম্পি দেবনাথকে। কিন্তু দুজনেই তখন সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মাম্পিকে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার উৎসাহ দেন মানিক। বাংলাতে এম এ পাশ করে বি এড় পাশ করেন মাম্পি। এ বছর জানুয়ারি মাসে তাদের এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কন্যা সন্তানকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যাধুনিক গাড়ি ভাড়া করেন মানিক। প্রায় কুড়িটি বাইক নিয়ে র্যালি করে শহর পরিক্রমা করে আনন্দনগরে নিয়ে যায় সদ্য জন্মানো কন্যা আরশিকে। বাড়িতে তখন উৎসবের মেজাজ। বাড়ির সামনে সার বেঁধে প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে।রঙিন বেলুন দিয়ে সাজানো গাড়ি থেকে ঠাকুমার কোলে চড়ে মায়ের সঙ্গে নামে আরশি। উলুখুনি ও ব্যান্ডের বাজনায় স্বাগত জানানো হল তাকে সাদা কাপড় বিছানো পথে। হলুদ গাঁদার পাপড়ি ছড়ানো চারদিকে। গাঁদা ফুলের পাপড়ি বিছানো পাত্রে পা রেখে, আলতায় পা ডুবিয়ে আরশির প্রথম পা রাখা। সাদা কাপড়ে পড়ল পায়ের ছাপ। ব্যান্ডের তালে তালে তখন নাচছেন আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শি। আরশিকে ঘিরে সে কী উন্মাদনা।
সেই স্কুলজীবন থেকে মানিক দেবনাথের স্বপ্ন কন্যা সন্তানের। একই স্বপ্ন বিয়ের পর দেখছেন মাম্পি দেবনাথও। গর্ভাবস্থায় মাম্পি দেবনাথ পরিষেবা পেয়েছেন আনন্দনগর প্রাথমিক হাসপাতালে। জিবিপি হাসপাতালেও পেয়েছেন পরিষেবা। আরশিকে ঘিরে উন্মাদনায় আনন্দিত বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জে এল বৈদ্যও। সদ্য ভূমিষ্ঠকে সন্তান না ভেবে যারা পুত্র কনায় ভাগ করেন, ছেলে হয়নি বলে যারা মনে মনে, কখনও প্রকাশ্যে ক্ষেদ প্রকাশ করেন এই ঘটনা তাদের মনেও রেখাপাত করবে। আমরা জানি প্রতিটি পরিবারে অবয়বে মানিক ও মাম্পি থাকা অসম্ভব নয়। আরশিতো মাম্পি ও মানিকের মনের আয়না। তাদের মন মানসিকতা, উন্নত চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি ঘরে। সর্বত্র, দেশ থেকে দেশান্তরে।
(• স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে প্রচারিত বিশেষ নিবন্ধ।)