উপনির্বাচনে শাসক দলের জয়ী হওয়াটাই অলিখিত নিয়ম, সাত মাস পর ফের ‘পরীক্ষা’

স্টাফ রিপোর্টার, আগরতলা, ২৬ জুন।। রাজধানীর একাংশ কেড়ে নিলো ‘শত্রুপক্ষ”। রাজধানী হাতছাড়া হলে যে কোনও রাজা-মহারাজা ভীত হতে বাধ্য। আগামী আশঙ্কায় তখন কেঁপে ওঠে বুক৷ এমন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। ৭ মাস পর ফের পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা দিতে হবে রাজ্যজুড়েই। প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, পদ্ম-পতাকা তুলে ধরে রাখা যাবে তো? ওদিকে শেষ পাওয়া খবর, ত্রিপুরায় নিজেদের জমি শক্ত করতে নামা তৃণমূল কংগ্রেসের চার প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

ওদিকে বামেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তার মুখে। সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি তিপ্রামথা। ত্রিপুরাকে পাখির চোখ করা তৃণমূল ৪ আসনের একটিতেও আশাপ্রদ ফল করতে পারেনি। সব কেন্দ্রেই শোচনীয় ফল৷ টাউন বরদোয়ালি কেন্দ্রে তৃণমূলের ওজনদার প্রার্থী সংহিতা ভট্টাচার্য পেয়েছেন মাত্র ৯৮৬টি ভোট। বাম প্রার্থী পেয়েছেন ৩,৩৭৬টি ভোট।

ওদিকে সুরমা আসন হাতছাড়া হয়েছে বামেদের। জিতেছে বিজেপি। যুবরাজনগর আসনও লাভ করেছে বিজেপি। আপাতত প্রাপ্ত হিসেব বলছে, তৃণমূল গড়ে ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে। চার আসনেই জামানত খুইয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ ভোট হওয়া মোট ৪ আসনের মধ্যে ৩ আসনে জয়ী হয়েছে বিজেপি, একটিতে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস।পাঁচ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার পরেও আগরতলা বিধানসভা কেন্দ্রটির দখল নিতে ব্যর্থ হয়েছে ত্রিপুরার বিজেপি।

মুখ্যমন্ত্রী বদল করেও লাভ হয়নি। পাঁচবারের বিধায়ক, কংগ্রেসের সুদীপ রায় বর্মন বিজেপিকে দুরমুশ করে আগরতলায় উড়িয়ে দিয়েছেন জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা। নিজের আসন ধরে রাখার পাশাপাশি সুদীপ কংগ্রেসকে অক্সিজেন দিয়ে ক্যারিশমাও দেখালেন। বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসের টিকিটে আগরতলা থেকে লড়েছেন এবং জিতেছেন ৩১৬৩ ভোটে। তাঁর দাপটেই ত্রিপুরার মাটিতে কংগ্রেসের পুনরুত্থান হল। আগরতলার আসনে সুদীপের জয় তাই একান্তই জরুরি ছিল কংগ্রেসের বৃহত্তর স্বার্থেই।

সুদীপ নিকটতম গেরুয়া প্রার্থীকে হারিয়েছেন ৩১৬৩ ভোটে। এবং একইসঙ্গে মুখের মতো জবাব দিয়েছেন বিজেপি এবং তৃণমূলকে। ত্রিপুরায় ২০১৮ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার সময় সুদীপ রায় বর্মন গেরুয়া শিবিরেই ছিলেন৷ ত্রিপুরায় পরিবর্তনের লড়াইয়ে তাঁর অবদানও কম ছিল না। বিপ্লব দেব মন্ত্রিসভায় তাঁকে মন্ত্রী করা হলেও পরে সুদীপকে অপসারিত করা হয়।

অপমানিত বোধ করায় পদ্ম-শিবির ছাড়েন তিনি, ইস্তফা দেন বিধায়ক পদ থেকেও৷ তখনই তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল৷ তৃণমূল বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর দিল্লি উড়ে গিয়ে রাহুল গান্ধীর উপস্থিতিতে সদলবলে হাতে তুলে নেন কংগ্রেসের পতাকা৷ আর তারপর এই উপনির্বাচনে নিজের পুরোনো কেন্দ্র আগরতলায় হাত প্রতীকের প্রার্থী হন।

বাকিটা ইতিহাস। কোনও উপনির্বাচনে শাসক দলের জয়ী হওয়াটাই অলিখিত নিয়ম। সেই নিয়মকে বস্তাবন্দি করে নিজের কেন্দ্রে উড়িয়ে দিলেন বিজেপিকে। পূর্ব ভারতে দীর্ঘদিন পর কোনও কংগ্রেস প্রার্থী জয়ী হলেন৷ এবং বিরোধী সব পক্ষকে সুদীপ রায় বর্মন বার্তা দিলেন, শাসক শিবিরে থেকে তো বাঁশ-লাঠিও ভোটে জিততে পারে। কিন্তু, বিরোধী প্রার্থী হিসেবে শাসক দলকে পর্যুদস্ত করতে কবজির আলাদা জোর লাগে, সেটা তাঁর আছে।

সাম্প্রতিক ত্রিপুরা পুরভোটের ফলে দেখা গিয়েছে শতাংশের হিসাবে দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেনি কংগ্রেস। এই অবস্থায় ত্রিপুরার উপনির্বাচনে সুদীপের জয়ে ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে কংগ্রেস। ত্রিপুরায় কংগ্রেস অক্সিজেন পেয়ে গিয়েছে৷ সুদীপ রায় বর্মনের ঘর ওয়াপসিতেই ত্রিপুরায় কংগ্রেস হয়ে গিয়েছে বিজেপির আসল চ্যালেঞ্জার। সিপিএম বা তৃণমূল এই ভোটে ধর্তব্যের মধ্যেই আসেনি।

ত্রিপুরার ৪ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল ঘোষণা হয়েছে রবিবার। ভোট হয় আগরতলা, টাউন বড়দোয়ালি, সুরমা এবং যুবরাজ নগর কেন্দ্রে৷ যে ৪ আসনে উপনির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে ৩টি ছিল বিজেপির দখলে। আগরতলা, বরদোয়ালি ও সুরমায় জিতেছিল বিজেপি। যুবরাজনগর ছিল সিপিএমের ঝুলিতে।

বিজেপির জেতা ৩ আসনের মধ্যে দুই বিধায়ক কংগ্রেসে ফিরে গিয়েছেন, এরা হলেন সুদীপ রায় বর্মন এবং আশিস সাহা। আর একজন, আশিস দাস, তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর ফের ছেড়েছেন ঘাসফুল শিবির। তিনি এবার প্রার্থী হতে পারেননি দলত্যাগ বিরোধী আইনের ফাঁসে। এই প্রথমবার ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ত্রিপুরার নতুন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা। টাউন বড়দোয়ালি কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী মানিক সাহা কত ভোট পান, নজর ছিল সেদিকেও।

ফলপ্রকাশের পর দেখা গিয়েছে কংগ্রেসের আশিস সাহাকে প্রায় ৬ হাজার ভোটে হারিয়েছেন মানিক সাহা। এর ফলে মুখ্যমন্ত্রীর আসন ধরে রাখলেন মানিক। যদিও সুদীপ রায় বর্মন মুখ্যমন্ত্রীর এই জয়কে ‘রিগিং আর গুণ্ডামির জয়’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই উপনির্বাচনে কংগ্রেস এবং সিপিএম নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেতে মরিয়া ছিল। কংগ্রেস সরমা আসনটি ছেড়েছে টিপ্রাকে৷ তৃণমূল কংগ্রেসও ত্রিপুরার জমিতে নিজেদের পা শক্ত করতে চাইছিল। কংগ্রেস ছাড়া বাকি সব পক্ষই কার্যত তলিয়ে গিয়েছে।

ফলপ্রকাশের পর রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ, ত্রিপুরার রাজনীতিতে এখন বিজেপির জন্য অশনি সংকেত হয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস শুধু শক্তিই বাড়ায়নি, বিজেপির ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসানোর চেষ্টাও চালিয়েছে সুরমা আসনটি টিপ্রা মথাকে ছেড়ে৷ এই জোট দীর্ঘজীবী হলে সিংহভাগ জনজাতি ভোট কংগ্রেসের দিকে চলে যেতে পারে। ত্রিপুরার জনজাতি ভোট বড় ফ্যাক্টর৷

এই ভোট গত নির্বাচনে বিজেপির দিকে যায় আইপিএফটির সৌজন্যে।এবারে অবশ্য আইপিএফটির অস্তিত্ব ছিল না। আইপিএফটির দুই গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইও তুঙ্গে। এই ফাঁক দিয়েই প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মনের নতুন দল তিপ্রামথা ঘাঁটি গেড়েছে জনজাতি ভোটব্যাঙ্কে৷ তিপ্রামথা পিছনে রয়েছে ত্রিপুরার জনজাতি ভোটের একটা বড় অংশের সমর্থন।  সেই সুযোগ নিতেই কংগ্রেস হাত বাড়িয়েছে তিপ্রামথার দিকে।

প্রসঙ্গত, এডিসি’র ভোটে মুখ থুবড়ে পড়েছিল বিজেপি। চার কেন্দ্রের ফলাফল হাতে নিয়ে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কংগ্রেসের এই উত্থানে নতুন অঙ্ক কষতে হবে বিজেপি, সিপিএম ও সদ্য ত্রিপুরায় পা দেওয়া তৃণমূলকে। আর এই নতুন হিসেবের মধ্য থেকেই তৈরি হবে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ। কারন,আর মাত্র সাত মাস পরেই বিধানসভা ভোটের দামামা বেজে যাবে ত্রিপুরায়।

 

You May Also Like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যাট খুলুন
1
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠান
হেলো, 👋
natun.in আপনাকে কিভাবে সহায়তা করতে পারে?