অনলাইন ডেস্ক, ২৯ এপ্রিল।। এ যাবৎকালে নিলামে ওঠা বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিরাটি বিক্রি হয়ে গেল হংকংয়ে। দাম উঠল ৫৭.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৪৯৭ কোটি টাকারও বেশি। হিরাটির নাম ‘দ্য ডি বিয়ার্স কুল্লিনান ব্লু’।
১৫.১০ ক্যারেটের হিরাটির আনুমানিক মূল্য ধরা হয়েছিল হয়েছিল প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু নিলামে উঠতেই হিরাটি ঘিরে শুরু হয়ে যায় দড়ি টানাটানি। আট মিনিট ধরে নিলাম চলার পর অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি টেলিফোন মারফত সর্বোচ্চ দাম দিয়ে কিনে নেন হিরাটি।
২০২১ সালে আফ্রিকার কুল্লিনান খনিতে পাওয়া গিয়েছিল হিরাটি। হিরার গুণমান বিচারকারী সংস্থা জেমোলজিকাল ইনস্টিটিউট অব আমেরিকা রং ও গঠনের উপর ভিত্তি করে হিরাটিকে ‘অতি বিরল’ ‘ফ্যান্সি ভিভিড ব্লু’ হিরা বলে চিহ্নিত করে।
সংস্থাটি এ পর্যন্ত যত হিরা পরীক্ষা করেছে তার মধ্যে কেবল ১ শতাংশ হিরা এই তকমা পেয়েছে বলে জানা গেছে। নিলামকারী সংস্থার দাবি এ যাবৎ এই ধরনের যত হিরা তারা নিলামে তুলেছে তার মধ্যে শুধু ৫টি হিরা ১০ ক্যারেটের বেশি ছিল। কিন্তু ১৫ ক্যারেটের বেশি ওজনের নীল হিরা এই প্রথম দেখা গেল।
হিরাটির নামের ‘ডি বিয়ার্স’ অংশটি এসেছে উত্তোলক সংস্থা ডি বিয়ার্সের নাম থেকে। হিরাটি কাটা ও পালিশ করার দায়িত্ব ডায়াকোর নামক অপর একটি সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে পালন করেছে ডি বিয়ার্স। হিরাটি কাটা হয়েছে স্টেপ কাট শৈলীতে। সাধারণত সাদা হিরা এই পদ্ধতিতে কাটা হয়।
শুধু হিরাটি নয়, যে সংস্থা হিরাটি বাজারে এনেছে সেই ডি বিয়ার্স নামক সংস্থাটিও কিন্তু কম বর্ণময় নয়। ডি বিয়ার্স সংস্থাটির জন্ম ১৮৮৭-৮৮ সালে। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ সেশিল জন রোডস এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা।
সেশিল রোডস সাহেব ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে ভারত উপমহাদেশ দখল করেছিল, তেমনই রোডসের ‘ব্রিটিশ সাউদ আফ্রিকা কোম্পানি’ আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে। গোটা অঞ্চলটির নাম রাখা হয় ‘রোডেশিয়া’। স্থানটিকে এখন আমরা চিনি জিম্বাবোয়ে ও জাম্বিয়া নামে। তৎকালীন আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তের ব্রিটিশ উপনিবেশ কেপ কলোনির প্রধানমন্ত্রীও হন রোডস।
শিক্ষাক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যতম সম্মানীয় বৃত্তি, রোডস স্কলারশিপও শুরু করেন তিনিই। জাতি হিসেবে ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস ছিল তার। তাই বিশ্ব জুড়ে ইংরেজি ভাষার প্রসার ও প্রচারের জন্য এই বৃত্তি চালু করেন তিনি। আজও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্তাবধানে এই স্কলারশিপ বন্টন করা হয়।
জন্মলগ্ন থেকে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত, প্রায় একশ বছর ধরে গোটা বিশ্বের হিরা উত্তোলন ও বিক্রয়ের দুনিয়ায় একাধিপত্য ছিল ডি বিয়ার্সের। বিশ্বের সব ধরনের হিরা ক্রয়-বিক্রয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই হত এই সংস্থার হাত ধরে।
বাণিজ্যের একাধিপত্য ধরে রাখতে ‘অনৈতিক’ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগও ওঠে ব্রিটিশ সংস্থাটির বিরুদ্ধে। আফ্রিকার একাধিক স্থানে দীর্ঘ দিন ধরে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। যেভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশ থেকে ধন-সম্পদ লুট করে, অনেকের অভিযোগ ঠিক তেমন ভাবেই এই সংস্থা আফ্রিকার হিরা লুট করে।
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি ছিল ‘ব্লাড ডায়মন্ড’ কেনা-বেচা করার। বিংশ শতকের শেষদিকে আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। অ্যাঙ্গোলা, আইভরি কোস্ট, লাইবেরিয়া, কঙ্গোর মতো দেশে ক্ষমতা দখলের জন্য লুট, ধর্ষণ ও গণহত্যা চালাতে থাকে যুদ্ধবাজ সামরিক নেতারা। এই নেতারা টাকার জন্য শিশু ও সাধারণ মানুষকে ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করে হিরা উত্তোলন করতে থাকে। এই হিরাগুলোকে রক্তস্নাত হিরা বা ‘ব্লাড ডায়মন্ড’ বলা হয়।
অভিযোগ ওঠে এই যুদ্ধবাজ নেতাদের থেকে হিরা কেনে ডি বিয়ার্স। সরকারিভাবে সংস্থাটি এই কথা স্বীকার না করলেও নব্বইয়ের দশকে ডি বিয়ারস ৭৭৭ ক্যারেটের বিশাল একটি হিরা কেনে। বিখ্যাত এই হিরাটির নাম ‘মিলেনিয়াম স্টার’। জানা যায় এটি ছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত কঙ্গো থেকে প্রাপ্ত একটি হিরা।
বিংশ শতকের শুরুতে এই ধরনের হিরা কেনা-বেচা নিয়ে প্রবল সমালোচনা শুরু হয় আন্তর্জাতিক মহলে। শেষ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘ ও একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চেষ্টার ফলে এই ধরনের হিরা কেনা-বেচা নিষিদ্ধ হয়। ডি বিয়ার্স কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, এই ধরনের কোনও হিরা এখন তারা ক্রয়-বিক্রয় করে না।
নব্বইয়ের দশকের পরপরই হিরার বাজারে ডি বিয়ার্সের একাধিপত্য কমতে থাকে। তবে একাধিপত্য কমলেও সংস্থাটি আজও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হিরা বিপণন সংস্থা। হিরার বাজারের ২৯ শতাংশ এখনও তাদেরই দখলে।