পালাতে চাইলে বাধ্য হয়ে রাশিয়ার দিকেই যেতে হবে

অনলাইন ডেস্ক,২২ এপ্রিল।। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধরত রুশ সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন ইউক্রেনের মারিওপোলের আজভস্টাল শিল্প এলাকায় হামলা না চালিয়ে বরং অবরোধ আরোপ করে এবং সেখান থেকে বের হওয়ার সব পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।

অবরুদ্ধ শহরটিতে ইউক্রেনিয়ান সেনাদের দখলে থাকা সর্বশেষ এই এলাকাটিতে রুশ সৈন্যরা যে অভিযানের পরিকল্পনা নিচ্ছিল, প্রেসিডেন্ট পুতিন তা বন্ধ রাখতে বলেছেন। পরিবর্তে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, এলাকাটির চারপাশে এমনভাবে অবরোধ তৈরি করতে, যাতে সেখান থেকে একটা মাছিও বেরুতে না পারে।

টেলিভিশনে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট পুতিন এসব কথা বলেছেন। তিনি মারিওপোলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শুইগোকেও অভিনন্দন জানান। শুইগো জানিয়েছেন, মারিওপোলের আজভস্টাল শিল্পাঞ্চলে এখন প্রায় দুহাজার মানুষ আছে।

মারিওপোলের ওপর গত দুমাস ধরে রুশ হামলায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। ইউক্রেন বলছে এই শিল্পাঞ্চলে অবশিষ্ট ইউক্রেনিয়ান সৈন্যরা ছাড়াও হাজার খানেক বেসামরিক মানুষও আটকা পড়েছে।

রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযানের শুরু থেকেই মারিওপোল দখল করা তাদের এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করেছিল। কিন্তু বিগত সপ্তাহগুলোতে মারিওপোলে রুশ সেনারা তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

 

কেন কৌশল বদলানোর নির্দেশ দিলেন পুতিন?

আজভস্টাল শিল্প এলাকা বিশাল বড় একটা এলাকা, একশো বর্গকিলোমিটারেরও বেশি। শুধু তাই নয়, এই শিল্পাঞ্চলে মাটির নীচে আছে বহু টানেল, আছে অনেক ওয়ার্কশপ। বলা হচ্ছে, সেখানে মাটির নীচে আছে আরেকটি নগরী। কাজেই ইউক্রেনিয়ানরা রুশদের বিরুদ্ধে যে ধরণের প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত, সে ধরণের যুদ্ধ চালানোর জন্য এটা আদর্শ জায়গা। তাই রুশরা যদি এই অঞ্চলটি দখল করার জন্য একটি পূর্ণ অভিযান চালায়, তাদের জন্য কাজটা সহজ হবে না। যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে।

সেজন্যেই প্রেসিডেন্ট পুতিন, এখন এটি দখলের অভিযান চালানোর পরিবর্তে সেটি অবরোধের নির্দেশ দিয়েছেন বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।

যুক্তরাজ্যের একজন সমর বিশেষজ্ঞ, জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারন্সও সেকথাই বলছেন। তার মতে, এটি দখল করতে গেলে রাশিয়াকে বিরাট মূল্য দিতে হতে পারে, যে ধরণের লড়াই সেখানে হবে, তাতে দুপক্ষেই প্রচুর রক্তক্ষয় হবে। রাশিয়া হয়তো ভাবছে, এই শিল্পাঞ্চলটি দখলে নেয়ার জন্য এত মূল্য দেয়ার কোন মানে আছে কিনা।

এমনিতেই আজভস্টাল শিল্প এলাকায় ইউক্রেনিয়ানরা বিপদে আছে, তাদের রসদ ফুরিয়ে গেছে। কাজেই অবরোধের মাধ্যমেই বরং তাদের আরও বেশি কাবু করা যাবে, এটাই হয়তো ভাবছে রাশিয়া। আর তারা হয়তো আসলে ডনবাস অঞ্চলের লড়াইয়ের দিকেই মনোযোগ দিতে চায়। মারিওপোলের বেশিরভাগ অংশ কিন্তু ইতিমধ্যেই রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।

এসব কিছুই হয়তো রাশিয়ার এই কৌশলের পেছনে কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে।

 

ডনবাস অঞ্চলে তীব্র লড়াই

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, রাশিয়া পুরো ডনবাস অঞ্চলে এবং দক্ষিণ ইউক্রেনে যেসব জায়গায় লড়াই চলছিল, তার সবগুলোতেই হামলা অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া ডনবাসের দোনেৎস্ক অঞ্চলের ৪২টি গ্রামও দখল করে নিয়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। আর লুহানস্কের ৮০% ইতিমধ্যেই রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

রুশরা ইউক্রেনের সামরিক এবং বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা হামলা চালাচ্ছে। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা দপ্তর জানিয়েছে, ডনবাস অঞ্চলের ক্রামাটোরস্ক শহরে রাশিয়া ক্রমাগত রকেট হামলা চালাচ্ছে।

আরও উত্তরে খারকিভের মেয়র জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টা ধরে সেখানে গোলাবর্ষণ চলছে। তবে এর তীব্রতা আগের চেয়ে কমে এসেছে। তিনি শহরের বাসিন্দাদের তাদের আশ্রয় কেন্দ্রের ভেতরেই থাকতে বলেছেন, কারণ দক্ষিণ-পূর্বের ইজিয়ুমে লড়াই চলছে। তিনি বলছেন, শহরে এখনো দশ লাখ মানুষ রয়ে গেছে। তবে তিরিশ শতাংশের মতো বাসিন্দাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ।

ব্রিটিশ সমর বিশেষজ্ঞ জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারন্স বলছেন, ডনবাস অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব দিকের লড়াইটা রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে তারা ইউক্রেনিয়ান বাহিনীকে ঘিরে ফেলতে চাইছে। যদি তারা এটা করতে পারে, সেটা হবে তাদের জন্য একটা বড় সাফল্য।

 

পালাতে চাইলে বাধ্য হয়ে রাশিয়ার দিকেই যেতে হবে

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, পূর্বাঞ্চলের যেসব শহর রাশিয়া দখলে, সেখানে তারা সীমান্তের কাছাকাছি শহরগুলো থেকে বেরুনোর পথ বন্ধ করে দিচ্ছে, কেবল রাশিয়ার দিকে যাওয়ার পথ খোলা রাখা হচ্ছে। ফলে, যারা পালাতে চান, তাদেরকে বাধ্য হয়ে রাশিয়ার দিকেই যেতে হবে।

এছাড়া খারকিভ অঞ্চলের ভেলিকি বারলুকের আশেপাশে যে কোন ধরণের উদ্ধার তৎপরতা বা মানবিক ত্রাণ কার্যক্রমের ওপরও রুশরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলে দাবি করছে ইউক্রেনিয়ান সূত্রগুলো।

 

মারিউপোলের বাসিন্দাদের ভাগ্য এখন পুতিনের হাতে

মারিওপোলের মেয়র বলেছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত মারিউপোলে আটকে থাকা এক লাখ বেসামরিক নাগরিকের ভাগ্য এখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাতে এবং এসব মানুষের সাথে কী ঘটবে তা তিনি (পুতিন) একাই নির্ধারণ করতে পারেন।

তিনি আরও বলেছেন, উপগ্রহ থেকে পাওয়া মারিউপোলের একটি গণকবরের ছবি প্রমাণ করে যে, রাশিয়ার সেনারা নিহতের সংখ্যা লুকাতে মৃতদেহ কবর দিচ্ছে।

এর আগে মারিউপোলকে মুক্ত করা হয়েছে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার দাবি করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। টানা প্রায় দুই মাস অবরুদ্ধ করে রাখার পর ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় এই বন্দরনগরী দখলের দাবি করেন তিনি।

দুই মাসের এই রুশ অবরোধ ও প্রচণ্ড বোমাবর্ষণে শহরে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। ফলে যেসব বাসিন্দা পালিয়ে যাননি তারা বিদ্যুৎ, গরম বা পানি সংকটে ভোগান্তিতে পড়েন।

বৃহস্পতিবার এক সাক্ষাৎকারে মারিউপোলের মেয়র ভাদিম বয়চেঙ্কো বলেন, ‘এটি বুঝতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, মারিউপোল শহরে এখনও আটকে মানুষের ভাগ্য কেবল একজন ব্যক্তির হাতে – ভ্লাদিমির পুতিন। এবং এখন থেকে যে সব মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে তাও তার (পুতিনের) হাতে’।

মারিউপোলকে ‘মুক্ত’ করা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেন রুশ প্রেসিডেন্ট। এর ফলে টানা প্রায় দুই মাসের সামরিক অভিযোনে প্রথম বড় কোনো ইউক্রেনীয় শহর দখলে নিলো রাশিয়া।

ইউক্রেনের মাসে ৭০০ কোটি ডলার প্রয়োজন

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, প্রতি মাসে ইউক্রেনের ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন। রাশিয়ার আক্রমণের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এই অর্থ প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংকের একটি ফোরামে দেওয়া ভার্চুয়াল বক্তৃতায় একথা বলেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি।

তিনি অভিযোগ করেন, কৃষ্ণসাগরের ইউক্রেনীয় বন্দরে রাশিয়ার অবরোধ ইউক্রেনের রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়ার এই পদক্ষেপ বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

বৃহস্পতিবার রাতে দেওয়া পৃথক এক ভিডিওবার্তায় ভলোদিমির জেলেনস্কি অভিযোগ করেন, অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের ইস্টার উৎসবকে কেন্দ্র করে যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব দেওয়া হলেও রাশিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আগামী ২৪ এপ্রিল রোববার অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের ইস্টার উৎসব পালিত হবে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে বিশ্বজুড়ে খ্রিস্টান পাদ্রীদের সিনিয়র সদস্যরা রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চকে চাপ দিচ্ছেন। তবে রুশ অর্থোডক্স চার্চ এ বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।

বৃহস্পতিবার রাতের ওই ভিডিওবার্তায় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেন, যুদ্ধবিরতি প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও তিনি এখনও শান্তির আশা পোষণ করেন। অবশ্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকারি বাসভবন ও কার্যালয় ক্রেমলিন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেনি।

 

শান্তি প্রস্তাবে সাড়া নেই কেন, জেলেনস্কিকে প্রশ্ন

ইউক্রেনে সামরিক অভিযান বন্ধ ও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবনার খসড়া ইতোমধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দপ্তরে পাঠিয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন; কিন্তু এখনও এ বিষয়ে জেলেনস্কির পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি বলে জানিয়েছেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ।

গত সোমবার এই খসড়া পাঠানো হয়েছে; কিন্তু কী কারণে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কোনো প্রতিক্রিয়া জানালেন না- সেই প্রশ্নও তুলেছেন পেসকভ।

বৃহস্পতিবার মস্কোতে এক সংবাদ সম্মেলনে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘যেমনটা আমি গতকাল বলেছিলাম, আজ আবারও বলছি (ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি ঘোষণায়) আমাদের যেসব শর্ত রয়েছে, সেসব ইতোমধ্যে আঙ্কারার বৈঠকে অংশ নেওয়া ইউক্রেনের প্রতিনিধিদলের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে’।

‘গত সোমবার এই খসড়া পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট এ সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। আমরা তার কারণ জানতে চাই’।

জেলেনস্কি অবশ্য বুধবার এক ভিডিওবার্তায় বলেছেন, রাশিয়া থেকে শান্তিচুক্তি সম্পর্কিত কোনো খসড়া এসেছে- এমন কোনো সংবাদ তিনি পাননি।

বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা এ বিষয়টি জানালে পেসকভ বলেন, ‘সেক্ষেত্রেও আমাদের প্রশ্ন আছে; আর সেটি হলো- কেন তিন দিন পেরিয়ে যাবার পরও কেউ প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে আমাদের প্রস্তাবনা সম্পর্কে অবহিত করল না।

 

ইউক্রেনে আরও অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে আর আটশ মিলিয়ন ডলারের নিরাপত্তা সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছেন।

তার ঘোষণা অনুযায়ী, এ সহযোগিতার আওতায় ইউক্রেন ভারী অস্ত্র, গোলাবারুদ ও কৌশলগত কাজে ব্যবহার করা যায়- এমন ড্রোন সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে ‘মুক্তির জন্য লড়াইরত’ সেনাদের কাছে পাঠাবে।

You May Also Like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যাট খুলুন
1
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠান
হেলো, 👋
natun.in আপনাকে কিভাবে সহায়তা করতে পারে?