।। কাকলি ভৌমিক ।। বিশ্রামগঞ্জ বাজার থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ইট বিছানো রাস্তা পেরিয়ে গেলেই চোখে পড়ে সবুজ সাজানো পরিবেশ বান্ধব গ্রাম বকুরবাড়ি। এই গ্রামে ৫০টি পরিবারের বসবাস। প্রায় প্রতিটি জনজাতি পরিবার কৃষির উপর নির্ভরশীল। ছোটোখাটো ব্যবসা বা অন্যান্য কাজ করেও কিছু পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বর্তমানে স্বনির্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত করে গ্রামীণস্তরে রোজগার বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি রাজ্য সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র। এ লক্ষ্যে রাজ্য সরকারের জৈব প্রযুক্তি ও ওএনজিসির সহযোগিতায় নির্বাচিত পরিবারগুলিকে আত্মনির্ভর করে তুলতে এবং তাদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস তৈরি করতে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বকুরবাড়িতে বায়োভিলেজ প্রকল্পের সূচনা হয়। মোট ৪০টি নির্বাচিত পরিবার এবং ৭৭ জন সুবিধাভোগীকে নিয়ে বকুরবাড়িতে বায়োভিলেজ প্রকল্পের পথচলা।
উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মার উপস্থিতিতে প্রতিটি নির্বাচিত পরিবারের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে জৈবসার, জৈব ওষুধ সম্বলিত বায়োটেক কীট, এলইডি বাল্ব, টিউবলাইট, এনার্জি ইউনিট ও সোলার পাম্পের মতো সেচ বান্ধব উপকরণ সহ মাছের পোনা, মোরগ ও ছাগল ছানা তুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও জুন মাসে নির্বাচিত ১২ জন সুবিধাভোগীকে প্রথম পর্যায়ে জনপ্রতি ২টি করে ২৪টি নীম পেস্টিসাইট দেওয়া হয় শাকসব্জি চাষাবাদের জীবাণুনাশক হিসেবে। এতে ব্যয় হয় ৬ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, প্রতিটি নির্বাচিত পরিবারের মহিলা সুবিধাভোগীদের স্বরোজগারী করে তোলার লক্ষ্যে জৈব প্রযুক্তি দপ্তরের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় মাশরুম চাষে। প্রশিক্ষণকালে নির্বাচিত ৪০টি পরিবারের ৪০ জন মহিলাকে ১০ প্যাকেট করে ২৫০ গ্রামের ৪০০টি মাশরুম স্পন দেওয়া হয়েছে।
মাসরুম চাষে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুমতি দেববর্মা এবং বনমালা দেববর্মা জানান, এখন তারা নিজ বাড়িতে এবং ঘরে মাশরুম চাষে সক্ষম হয়েছেন এবং তাদের উৎপাদিত মাশরুম বাজারে বিক্রি করে ক্রমশ লাভবান হচ্ছেন। তাদের আশা শুধুমাত্র মাশরুম চাষ করেই তারা একদিন স্বনির্ভর হতে পারবেন। গত জুন মাসে নির্বাচিত ৫ জন সুবিধাভোগীর বাড়িতে সোলার পাম্প বসানো হয়েছে। এতে সুবিধাভোগী পিছু ব্যয় হয়েছে ২.৫০ লক্ষ টাকা।
কিছুদিনের মধ্যে এরকম আরও ৭ জন সুবিধাভোগীর বাড়িতে ৭টি সোলার পাম্প বসানো হবে। অন্যদিকে, কিছুদিনের মধ্যে ৪০টি নির্বাচিত পরিবারে পরিবার পিছু ২টি করে শূকর ছানাও প্রদান করা হবে বলে জানান জৈব প্রযুক্তি দপ্তরের সায়েন্টেফিক অফিসার অঞ্জন সেনগুপ্ত। তিনি জানান, বায়োভিলেজ প্রকল্পে প্রাথমিক সার্ভের পর নির্বাচিত সুবিধাভোগীদের সাথে নিয়মিত সংযোগ সাধন, মতবিনিময়, প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন সরঞ্জাম বিতরণ, জমি পরিদর্শন এবং কারিগরী সহায়তা, মাটি, ফসল ইত্যাদির নমুনা সংগ্রহ এবং বাজারজাতকরণের সহায়ক পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে এর অন্যতম বিষয়।
এই কর্মসূচিতে গ্রামীণ জৈব প্রযুক্তি ও কৃষি প্রযুক্তির সাথে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির সম্মিলিত প্রয়োগের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বাস্তুতন্ত্র রক্ষা ও প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের উপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে শুধুমাত্র একজন সুবিধাভোগীই নয় বরং পরিবারের সকল সদস্যদের সার্বিক অংশগ্রহণ, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস অর্জন, সঠিক প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে অবগত করানোও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এছাড়াও নির্বাচিত সুবিধাভোগীদের জৈব সার, ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বছরে দু’বার করে দেওয়া হবে। এতে কৃষকরা জৈব চাষে উৎসাহিত হবে এবং কৃষিক্ষেত্রে অপরিমিত রাসায়নিক সারের ব্যবহার করার প্রবণতা হ্রাস করা যেতে পারে এবং উৎপাদিত ফসলের মূলাও বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, যে সকল পরিবারে একের অধিক গরু আছে তাদের বাড়িতে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে। এরফলে এলপিজি গ্যাসের নির্ভরতা হ্রাস পাবে। এই প্রকল্পে প্রতিদিন দু’ঘন্টা গ্যাসের যোগান দেওয়ার জন্য ৩০ কেজি গোবরের প্রয়োজন হবে।
গ্যাস উৎপাদনের পর অবশিষ্ট গোবর কৃষিক্ষেত্রে উৎকৃষ্টমানের সার হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। তপন দেববর্মা, বিশু কুমার দেববর্মা, সালকা দেববর্মা, জেবি দেববর্মা, মণিরাম দেববর্মা, বিশ্বনাথ দেববর্মা, শ্রীমতি দেববর্মারা জানান, বায়োভিলেজ প্রকল্পে এলইডি বাল্ব ব্যবহারে তারা ইলেকট্রিক বিলের সাশ্রয় করতে পারছেন এবং পর্যাপ্ত আলো ও সুনিশ্চিত হয়েছে। গ্রামের মানুষ আশা করে আছেন সবুজ প্রযুক্তি নির্ভর বায়োভিলেজ প্রকল্পের উপাদানগুলির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে এই গ্রামের নির্বাচিত প্রতিটি পরিবারের মাসিক আয় গড়ে ৫০ শতাংশ বাড়বে।