পৃথিবীর ঘুম বঞ্চিত দেশগুলোর মধ্যে একটি দক্ষিণ কোরিয়া

অনলাইন ডেস্ক,৭এপ্রিল।। দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে ঘুম বঞ্চিত দেশগুলোর মধ্যে একটি। ঘুমের অভাবে দেশটির জনসংখ্যার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

দেশটির একজন নাগরিক জি-ইউন। সম্প্রতি তার অফিসের কাজের চাপ এতোটাই বেড়ে যায় যে, তার ঘুমের সমস্যা হতে শুরু করে। তিনি আর আরাম করে ঘুমাতে পারেন না।

প্রতিদিন গড়ে তিনি সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করেন। কিন্তু কোনো কোনো দিন তাকে রাত তিনটা পর্যন্তও অফিসে থাকতে হত। তার বস প্রায়ই মাঝরাতে ফোন করে তাকে কাজ দিতেন।

তিনি বলেন, ‘অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কীভাবে বিশ্রাম নিতে হয় সেটাই আমি ভুলে গেছি’।

সিউলের চকচকে গ্যাংনাম জেলার ড্রিম স্লিপ ক্লিনিকের ঘুম বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জি-হিয়োন লি বলেন, তিনি প্রায়ই এমন রোগীর দেখা পান যারা রাতে ২০টি পর্যন্ত ঘুমের ওষুধ খান।

তিনি বলেন, ‘সাধারণত ঘুমাতে একটু সময় লাগে, কিন্তু কোরিয়ানরা খুব দ্রুত ঘুমাতে চায় এবং তাই তারা ওষুধ সেবন করে’।

ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তি দেশটিতে একটি জাতীয় মহামারী আকার ধারন করেছে। এই বিষয়ে কোন সরকারী পরিসংখ্যান নেই। তবে অনুমান করা হয় অন্তত ১ লাখ কোরিয়ান ঘুমের ওষুধে আসক্ত।

ওষুধ খেয়েও যখন তারা ঘুমাতে পারে না তখন তারা প্রায়শই ওষুধের পরে আবার মদও পান করেন। যা অনেক সময় বিপজ্জনক পরিণতি বয়ে আনে।

ডা. লি বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ায় লোকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হেঁটে বিছানা থেকে উঠে ফ্রিজের কাছে যায় এবং ঘুমের মধ্যে থেকেই অনেক কিছু খায়, এমনকি রান্না ছাড়া খাবার খায়। এমনকি সিউলের কেন্দ্রে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনাও ঘটে ঘুমন্ত পথচারীর কারণে’।

ডাঃ লি দীর্ঘদিন ধরে অনিদ্রায় ভোগা রোগীদের চিকিৎসা করছেন। তার কিছু রোগী তাকে বলেন যে, কয়েক দশক ধরে তারা রাতে মাত্র কয়েক ঘন্টা করে ঘুমিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘ঘুমাতে না পেরে তারা কাঁদেন। কিন্তু এরপরও একটু ঘুমানোর আশা নিয়ে তারা এখানে আসেন। এটি সত্যিই এক দুঃখজনক পরিস্থিতি’।

 

অতিরিক্ত পরিশ্রম, ক্লান্তি এবং ঘুম বঞ্চিত

দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীর অন্যতম ঘুম বঞ্চিত দেশ। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এটির আত্মহত্যার হারও সবচেয়ে বেশি। এদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি হার্ড লিকারের চা পান করেন এবং বিষণ্নতারোধী ওষুধ সেবন করেন।

এর ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। মাত্র কয়েক দশকে দেশটি পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। পপ সংস্কৃতিতেও দেশটি ক্রমবর্ধমানভাবে প্রভাব বিস্তার করছে।

সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো একই ধরনের দেশগুলো তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করতে পারে। কিন্তু কোরিয়ার কাছে এমন কোনও মাটির নীচের লুকানো সম্পদ নেই। দেশটির মানুষ সম্মিলিত জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিছক আত্ম-উৎসর্গের মাধ্যমে নিজেদেরকে উন্নত করেছে। এর জন্য তাদেরকে কঠোর পরিশ্রম এবং দ্রুত কাজ করার পদ্ধতি বেছে নিতে হয়েছে।

এর একটি ফল হল, দেশটির লোকেরা অতিরিক্ত কাজ করে অবসাদ্গ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং ঘুম বঞ্চিত হয়।

এখন, যারা ঘুমাতে পারেন না তাদের খাবারের জন্য আলাদা একটি শিল্প গড়ে উঠেছে। ২০১৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ঘুম শিল্পের মূল্য ছিল ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

 

ক্রমবর্ধমান ঘুম-সহায়তা শিল্প

সিউলে ঘুম সহায়ক চাদর ও বালিশ বিক্রি করার জন্য আস্ত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর রয়েছে। ফার্মেসিগুলোর তাক ভরা থাকে ঘুমের ভেষজ ওষুধ এবং টনিক দিয়ে।

অনিদ্রা দূর করতে নানা প্রযুক্তিগত পদ্ধতিও ব্যবহার হচ্ছে। দুই বছরের কিছু বেশি আগে ড্যানিয়েল টিউডর নামের একজন কোক্কিরি নামের একটি মেডিটেশন অ্যাপের মাধ্যমে ঘুম-সহায়তা দেওয়া শুরু করেন। এই অ্যাপের লক্ষ্য কোরিয়ান তরুণদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করা।

কোরিয়া ঐতিহাসিকভাবে একটি বৌদ্ধ দেশ হলেও তরুণরা মেডিটেশন বা ধ্যানকে সেকেলে বিনোদন হিসেবে গণ্য করে। যা সিউলের একজন অফিস কর্মী করতে পারে না। ড্যানিয়েল বলেন যে, তরুণ কোরিয়ানদের কাছে এটিকে ফের আকর্ষণীয় করার জন্য মেডিটেশনকে তাকে একটি পশ্চিমা ধারণা হিসাবে পুনরায় আমদানি এবং পুনরায় প্যাকেজ করতে হয়েছিল।

আরও বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানও এই কাজে যোগ দিয়েছে।

হায়রাং সুনিম নামের একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সিউলের প্রান্তের একটি মন্দিরে মানুষকে ঘুমাতে সহায়তা করেন। ওই মন্দিরে গিয়ে ঘুম-বঞ্চিতরা তার কাছে ধ্যান এবং বৌদ্ধ শিক্ষা গ্রহণ করেন।

অতীতে এই ধরনের মিনি-ব্রেকগুলো অবসরপ্রাপ্তদের জন্য সংরক্ষিত ছিল, যারা শিক্ষা এবং প্রার্থনা চাইতেন। এখন আরও কম বয়সীরাও অংশগ্রহণ করছেন, যারা নিয়মিত চাকরি-বাকরি বা কাজ করেন। তবে এই ধরনের বৌদ্ধ মন্দিরগুলো এমন সেবা দেওয়ার বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করায় সমালোচনারও শিকার হচ্ছে।

হায়রাং সুনিম বলেন, ‘অবশ্যই সমস্যা আছে… কিন্তু আমি মনে করি সুবিধাগুলো তার চেয়ে বেশি’।

‘সাধারণত অল্পবয়সীদের বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এখন তারা মন্দিরে থেকে অনেক কিছুই শিখছে’।

 

মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন

লি হাই-রি নামের এক নারী কাজের চাপ অত্যধিক হয়ে যাওয়ার পরে এমন একটি বৌদ্ধ মন্দিরে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন যে, তিনি এখন তার মানসিক চাপ কমানোর পদ্ধতি শিখে গেছেন।

লি হাই-রি বলেন, ‘সবকিছু আমার থেকে শুরু হয়, সব সমস্যা আমাকে দিয়েই শুরু হয়। এটাই আমি এখানে শিখেছি’।

কিন্তু মানসিক চাপ এবং ঘুমের অভাবকে ব্যক্তিগত স্তরে মোকাবেলা করার মতো কিছু হিসেবে দেখার মধ্য দিয়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে।

যারা বিশ্বাস করেন যে, সমস্যাটি একটি অযৌক্তিক কর্মসংস্কৃতি এবং সামাজিক চাপের কারণে সৃষ্টি হয়েছে তারা এই ব্যক্তিবাদী পদ্ধতির সমালোচনা করছেন এই বলে যে, এটি পরিস্থিতির শিকার ব্যক্তিকেই দোষারোপ করার সমতুল্য। এই সমালোচকরা বলেছেন যে, ধ্যান বা শিথিলতা হল একটি চটকদার প্লাস্টার এবং প্রকৃত সমাধান শুধুমাত্র সমাজে মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই আসতে পারে।

জি-ইউন শেষ পর্যন্ত এতটা ঘুম বঞ্চিত হয়েছিলেন যে, তিনি তার চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। আজকাল তিনি একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত কর্মঘন্টা ধরে কাজ করেন এবং মহামারীতে তিনি বাড়িতে থেকেই কাজ করতে পারেন। তিনি তার অনিদ্রা দূর করার জন্য ডাঃ লি এর ঘুমের ক্লিনিকেও চিকিৎসা নিয়েছেন।

জি-ইউন বলেন, ‘এখন আর এত কঠোর পরিশ্রম করার দরকার কী, আমরা তো এখন অনেক উন্নত দেশ তৈরি করে ফেলেছি? আমাদের এবার একটু আরাম করা উচিত’।

You May Also Like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যাট খুলুন
1
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠান
হেলো, 👋
natun.in আপনাকে কিভাবে সহায়তা করতে পারে?