অনলাইন ডেস্ক, ২৫ মার্চ।। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর সংবাদ শিরোনামে বার বার উঠে এসেছে পূর্ব ইউক্রেনের বন্দর শহর মারিওপোলের কথা। এখনো সেখানে তীব্র লড়াই চলছে। সেই মারিওপোল থেকেই প্রাণ বাঁচিয়ে পালাতে পেরেছেন স্থানীয় সাংবাদিক মিকোলা ওসিচেঙ্কো। তার মুখে ভয়াবহতার কাহিনি শুনলে মেরুদণ্ড দিয়ে ঠাণ্ডা রক্তের স্রোত বয়ে যায়। শহরটি যেন এক মৃত্যপুরীতে পরিণত হয়েছে। শহরটিতে অন্তত এক লাখ মানুষ আটকা পড়েছে, যারা এখন শুধু মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
মারিওপোলের একটি শিশু ও নারীদের হাসপাতালে বোমা ফেলেছিল রাশিয়া। তাদের দাবি ছিল, ওই ভবনটি সেনা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিকোলার বাড়ি ওই ভবনটি থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে। তিনি জানিয়েছেন, যেদিন ওই ভবনে বোমা ফেলা হলো, প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন তার বাড়িতেই বোমাবর্ষণ হয়েছে। বোমার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে তার বাড়িটিও কেঁপে উঠেছিল।
মিকোলার এখনো মনে আছে, বোমা ফেলার আগের দিন তার ৬০ বছরের আহত প্রতিবেশীকে ওই হাসপাতালেই ভর্তি করতে হয়েছিল। কারণ, দূরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তাকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছিল। আহত প্রতিবেশীকে ভর্তি করার সময় মিকোলা দেখেছিলেন ওই হাসপাতালের তৃতীয় তলে অসংখ্য নারী এবং শিশু ভর্তি ছিল। বোমাবর্ষণের পর আর তাদের দেখা যায়নি। ওই ঘটনার পর তারাও বেসমেন্টে নেমে যান। বাড়ির হিটিং বন্ধ হয়ে যায়।
হিমাঙ্কের নীচে তাপমাত্রা। তারমধ্যেই দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে তাদের। যে কয়েকটি ম্যাট্রেস ছিল তা শিশু এবং বয়স্কদের দেওয়া হয়েছিল। তারা সিঁড়িতে বসেই ঘুমিয়ে নিতেন। বরফ পড়লে জলের ব্যবস্থা হতো। কেউ কেউ হিটিং মেশিনের জল বার করে ফুটিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করেছে। খাবারও প্রায় শেষ বলে জানিয়েছেন তিনি। পরিবার এবং প্রতিবেশীদের নিয়ে পালানোর আগে যারা থেকে গেছেন, তাদের সামান্য খাবার আর জল দিয়ে এসেছেন তিনি।
নাতালিয়ার হৃদয় এখন তিন টুকরো :
নাতালিয়া কোরিয়াগিনা একজন স্বাস্থ্যকর্মী। তিনি জানিয়েছেন, তার হৃদয় এখন তিন টুকরো হয়ে আছে। মা আটকে গ্রামের বাড়িতে, স্বামী যুদ্ধ করছেন আর ছেলে খারকিভে।
মায়ের সঙ্গেই ছিলেন নাতালিয়া। কিন্তু আক্রমণ তীব্র হওয়ার পরে তিনি ঠিক করেন নদীর ধার ধরে শহরের দিকে চলে আসবেন। কিন্তু মা রাজি হননি। তিনি বাড়ি ছাড়ার একঘণ্টার মধ্যে তার বাড়ির সামনে বোমাবর্ষণ হয়। একটি স্কুল, দুই প্রতিবেশীর বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। তবে তাদের বাড়িটি তখনো বাসযোগ্য ছিল।
ফের মাকে নাতালিয়া অনুরোধ করেন তার সঙ্গে চলে আসার জন্য। মা রাজি হন। নাতালিয়া ততক্ষণে শহরে পৌঁছে গেছেন। ১৬ জন মিলে একটি বাড়ির বেসমেন্টে থাকার ব্যবস্থা হয়। নাতালিয়া একের পর এক ট্যাক্সিকে ফোন করতে থাকেন মাকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু একটি গাড়িও পাননি। সকলেই জানিয়েছেন, গ্যাস নেই। কোথাও গ্যাস পাওয়াও যাচ্ছে না।
শেষপর্যন্ত মাকে তিনি জানাতে বাধ্য হন, ফিরতে পারছেন না। সেটাই মায়ের সঙ্গে তার শেষ কথা। স্বামীর সঙ্গেও আর যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি। জানেন না খারকিভে ছেলের কী অবস্থা। এদিকে তারা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানেও একের পর এক আক্রমণ চলে। বোমাবর্ষণ হয়। গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে বাড়ির প্রতিটি জানলা। তবে বেসমেন্টে কিছু হয়নি।
দুইটি বাথটাবে বরফ জমিয়ে রেখেছিলেন তারা। ওটাই খাওয়ার পানি। ১৪ মার্চ মাঝরাতে বাড়ির পেছনে গিয়ে একটি গাড়ি নিয়ে পালান নাতালিয়া এবং তার বন্ধুরা। পালানোর সময় দেখেছেন, গোটা শহর ধ্বংস হয়ে গেছে। একটি বাড়িও আর আস্ত নেই। জায়গায় জায়গায় মৃতদেহ ছড়িয়ে। বারুদের গন্ধ চারিদিকে।