অনলাইন ডেস্ক, ২৬ ফেব্রুয়ারী।।আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে খিস্ট্রপূর্ব পঞ্চম শতকে চীনা সমর বিশারদ সান ঝু তার ‘আর্ট অফ ওয়ার’-এ লিখে গিয়েছিলেন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এমন কৌশলের কথা। ১৮৮২ সালে নোপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের সময় জার (রুশ সম্রাট) প্রথম আলেকজন্ডারের সেনা প্রথম হাতেকলমে প্রয়োগ করেছিল সেই নীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিরোধে একই কৌশল নিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জোশেফ স্তালিন। এবার রুশ বাহিনীর ত্রিমুখী হানা ঠেকাতে সেই ‘পোড়ামাটি (স্কর্চড আর্থ) যুদ্ধকৌশলই নিয়েছে ইউক্রেন সেনা।
‘শক্তিশালী শত্রুসেনার অগ্রগতি ধীর করাই ‘পোড়ামাটি নীতি’র মূল কথা। পিছু হঠার সময় রাস্তা, সেতু, সম্ভাব্য বাসস্থান এবং রসদের উৎস নষ্ট করে দেওয়া তার অন্যতম অঙ্গ। উদ্দেশ্য একটাই, বার বার বাধা পেয়ে শত্রুর আগ্রাসনের গতি কমলে পরবর্তী পর্যায়ের প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সময় পাওয়া যায়। হানাদার বাহিনীর মনোবলও ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যুদ্ধের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনে সেই কৌশলই নিয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সেনা।
বৃহস্পতিবার প্রথম দিনের যুদ্ধেই ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ এবং চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নেয় রুশ সেনা। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষিত ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ ডোনেৎস্ক ও লুহানস্ক (পূর্ব ইউক্রেনের এই দুই অঞ্চলকে একত্রে ডনবাস বলা হয়) এর সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী রুশ সেনা খারকিভ দখলের পর রাজধানী কিয়েভ অভিমুখে যাত্রা করে। অন্য দিকে, উত্তরে বেলারুশ সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়া রুশ ট্যাঙ্ক ব্রিগেড বৃহস্পতিবার গভীর রাতে চেরনোবিল দখলের পরে একই উদ্দেশ্যে এগোতে থাকে। ডেনিপার নদী পার হয়ে ইতিমধ্যেই রাজধানী কিয়েভের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে বেলারুশ সীমান্ত পেরিয়ে আসা বাহিনী।
রুশ আগ্রাসনের তৃতীয় কেন্দ্র, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ। সেখানে কৃষ্ণসাগরে আগে থেকেই মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক রুশ রণতরী। সেই সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দ্রুত ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে সেনা অবতরণের উদ্দেশ্যে তৈরি ‘অ্যাম্ফিবিয়ান ল্যান্ডিং ভেহিকল্’। সেগুলোর সাহায্যে দক্ষিণ ইউক্রেনের উপকূলবর্তী মারিউপোল এবং ওডেসায় রুশ বাহিনী অবতরণ করে। দক্ষিণ থেকে ধেয়ে আসা রুশ বাহিনীর উদ্দেশ্য, খেরসন প্রদেশ হয়ে কিয়েভের কাছে পৌঁছানো।
ত্রিমুখী হামলার মুখে পড়ে বৃহস্পতিবার থেকেই বিভিন্ন ফ্রন্টে একের পর এক কিয়েভ-মুখী সেতু ও রাস্তা নষ্ট করতে শুরু করেছে ইউক্রেন সেনারা। পিছু হঠার সময় ধ্বংস করছে নিজেদেরই সেনা শিবিরগুলো। এমনকি, খেরসানে নিজের শরীরে মাইন বেঁধে হেনিচেস্ক সেতু উড়িয়ে দিয়ে রুশ সাঁজোয়া বহর রুখে দিয়েছেন ইউক্রেনের নৌ সেনার ব্যাটালিয়ন ইঞ্জিনিয়ার ভিতালি স্কাকুন ভোলোদিমিরোভিচ।
নেপোলিয়ন এবং হিটলার বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘পোড়ামাটি নীতি’ নিয়ে আত্মরক্ষার লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিল রাশিয়া। এবার ইউক্রেনে আক্রমণকারী হিসেবে তারা নিজেরা আড়াই হাজার বছরের পুরনো চীনা রণনীতির মোকাবিলা কীভাবে করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ওদিকে, রাশিয়া বলছে কিয়েভের সঙ্গে আলোচনার প্রত্যাশায় ইউক্রেনে সামরিক অভিযান সাময়িকভাবে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কিন্তু দেশটির ক্ষমতাসীনরা আলোচনায় রাজি না হওয়ায় শনিবার আবারও ইউক্রেনে সেই অভিযান শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, গতকাল বিকেলের দিকে ইউক্রেনের নেতার সঙ্গে আলোচনার প্রত্যাশায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সামরিক বাহিনীর অগ্রযাত্রা স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইউক্রেনীয় পক্ষ আলোচনায় অস্বীকৃতি জানানোয় পরিকল্পনা অনুযায়ী, শনিবার বিকেলে রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা আবারও শুরু হয়েছে।