অনলাইন ডেস্ক, ১৫ ফেব্রুয়ারী।। সুরের জগতে ছন্দপতন। চলে গেলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার বাপ্পি লাহিড়ী। মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে আজ সকালে জীবনাবসান হয় তাঁর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। গত বছরই তিনি কোভিডে আক্রান্ত হন তিনি। কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর করোনামুক্ত হলেও, নানা শারীরিক জটিলতা শুরু হয়।
বাপ্পি লাহিড়ী এক অন্য ঘরানা সঙ্গীতশিল্পী থেকে সুরকার হিসেবে খ্যাতি শীর্ষে পাড়ি দেন। একের পর এক হিট গান উপহার দেন তিনি। এই বিশিষ্ট সুরকারের রচিত গানগুলির মধ্যে অন্যতম এক বার কহো (১৯৮০); সুরক্ষা; ওয়ারদাত; আরমান; চলতে চলতে; কমাণ্ডো; ইলজাম; পিয়ারা দুশমন; ডিস্কো ড্যান্সার; ড্যান্স ড্যান্স; ফিল্ম হি ফিল্ম; সাহেব; টারজান; কসম পয়দা করনে ওয়ালে কি; ওয়ান্টেড: ডেড অর এলাইভ; গুরু; জ্যোতি; নমক হালাল, শরাবী (১৯৮৫: এইতবার; জিন্দাগী এক জুয়া; হিম্মতওয়ালা; জাস্টিস চৌধুরী; নিপ্পু রাব্বা; রোদী ইন্সপেক্টর; সিমহাসনম; গ্যাং লিডার; রৌদী অল্লাদু; ব্রহ্মা; হাম তুমহারে হ্যায় সনম এবং জখমী। এছাড়াও তিনি মালায়ালম চলচ্চিত্র (কেরালা) দ্য গুড বয়েজ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন।
এছাড়াও এই কিংবদন্তী শিল্পী তাঁর নিজের লেখা কিছু গানে কন্ঠ দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে অন্যতম, রাহি হু মে (ওয়ান্টেড: ডেড অর এলাইভ); বোম্বাই সে আয়া মেরা দোস্ত (আপ কি খাতির); মৌসম হ্যায় গানে কা (সুরক্ষা); তুম জো ভি হো (সুরক্ষা); তু মুঝে জান সে ভি পিয়ার হ্যায় (ওয়াদাত); ইয়াদ আ রাহা হ্যায় (ডিস্কো ড্যান্সার); সুপার ড্যান্সার (ড্যান্স ড্যান্স); দেখা হ্যায় ম্যায়নে তুমহে ফির সে পলাতকে (ওয়ারদাত); দিল মে হে তুম (সত্যমেব জয়তে); জে লা লা (টারজান); বাম্বাই নাগারিয়া (ট্যাক্সি নং ৯২১১)।
হিন্দী চলচ্চিত্রে তাঁর এই উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ডিস্কো ঘরানা গীত প্রচলনের আগে বাপ্পি লাহিড়ী সৃষ্টি করেছেন ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা’, দিল সে মিলে দিল, দিল সে মিলে দিল (দিল সে মিলে দিল), ‘মুসকুরাতা হুয়া (লাহো কে দো রং)’, ‘চার দিন কি জিন্দেগী হ্যায় (এক বার কাহো)’, ‘ধীরে ধীরে সুবহ হুয়ে (হৈসিয়াত)’, ‘মান হো তুম (তুতে খিলোনে); তেরী ছোটি সি ভুল (শিক্ষা)’, ‘ইয়ে নায়না ইয়ে কাজল (দিল সে মিলে দিল)’, গাও মেরে মন (আপনে পরায়ে); পিয়া হি জিনে কি (আরমান)’, ‘পিয়ার মাঙ্গা হ্যায় তুমহি সে’, ‘কে পাগ ঘুঙ্গরাও বান্ধ মিরা নাচি থি’। তবে শুধুমাত্র শুধুমাত্র ডিস্কো সঙ্গীতের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখেননি বাপ্পি লাহিড়ী। বেশ কিছু গজল গানও রচনা করেছেন তিনি। কিসি নজর কো তেরা ইন্তেজার আজ ভি হ্যায় (এইতবার), আওয়াজ দি হিয়া (এইতবার) তার মধ্যে অন্যতম।
জন্ম ১৯৫২ সালে ২৭ নভেম্বর। বাপ্পি লাহিড়ী কলকাতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সমৃদ্ধ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক নাম আলোকেশ বাপ্পী লাহিড়ি। বাবা অপরেশ লাহিড়ী ছিলেন একজন বাংলা সঙ্গীতের জনপ্রিয় গায়ক। মা বাঁশরী লাহিড়িও ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়িকা। তাদের পরিবারেরই একমাত্র সন্তান বাপ্পি লাহিড়ী।
হিন্দী চলচ্চিত্র শিল্প-সহ বাংলা গানের গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক হিসেবে বাপ্পি লাহিড়ী একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। এছাড়াও, সঙ্গীত জগতে তিনি বাপ্পি-দা নামেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
১৯৮০’র দশকের চলচ্চিত্র বিশেষ করে ডিস্কো ড্যান্সার, নমক হালাল এবং শরাবী’র মতো বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করে তিনি মানুষের মনে জায়গা করে নেন।
তিন বছর বয়সেই তবলা বাজাতে শুরু করেন। পিতা-মাতার সান্নিধ্যে ছোটথেকেই সঙ্গীতশিক্ষায় তালিম শুরু হয়। এরপর তিনি ১৯ বছর বয়সে দাদু (১৯৭২) নামক বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করেন।
কলকাতা থেকে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই পাড়ি দেন মুম্বই। ১৯৭৩ সালে হিন্দী ভাষায় নির্মিত নানহা শিকারী ছবিতে তিনি প্রথম গীত রচনা করেন। এরপর তাহির হুসেনের জখমী (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে কাজ করেন। রবিকান্ত নাগাইচের সুরক্ষা ছবিতে গান গেয়ে সঙ্গীতকার হিসেবে জনপ্রিয়তা পান।
মিঠুন চক্রবর্তী’র ডিস্কো নাচের চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮০’র দশকে মিঠুন চক্রবর্তী এবং বাপ্পি লাহিড়ী একসঙ্গে বেশ কিছু ভারতীয় ডিস্কো চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এছাড়াও, তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে পরিচালিত অনেক হিন্দী চলচ্চিত্রের গানে অংশ নিয়েছেন। সমগ্র ভারতবর্ষে তিনি নিজেকে ‘ডিস্কো কিং’ নামে পরিচিতি লাভে সমর্থ হন।
১৯৯০ সাল নাগাদ ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন। প্রকাশ মেহরা’র ‘দালাল’ ছবিতে স্বল্প সময়ের জন্য ফিরে আসেন।
১৯৮৫ সালে বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান বাপ্পি লাহিড়ী। এর পর ২০১৮ সালে ফিল্ম ফেয়ার অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারে ভূষিত হন। গিমা পুরস্কার পান ২০১২ সালে।
গানের জগত ছাড়াও নিজের পোশাক ও ব্যক্তিত্বের কারণেও বাপ্পি লাহিড়ী নিজেকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। নিজেকে স্বর্ণ- অলংকারে সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। সেইসঙ্গে চোখে থাকত কালো চশমা।