।। মানিক লাল মালাকার।। প্রাচীনকাল থেকেই জীবিকা নির্বাহ ছাড়াও নানা কাজে মানুষ ছিল প্রাণীজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষ প্রাণী পালনকে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের পাশাপাশি আয়ের উৎস হিসেবেও ব্যবহার করতে শিখেছে। বর্তমান সময়ে প্রাণী পালন বাণিজ্যিক আকারে মানুষের জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করছে এবং দেশ ও রাজ্যের অর্থনীতির বিকাশের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের রাজ্যে প্রাণী পালনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। রাজ্যে দুধ, ডিম ও মাংসের যথেষ্ট চাহিদা থাকলেও যোগান পর্যাপ্ত নয়। চাহিদা ও যোগানের ঘাটতি পূরণে প্রাণীসম্পদ ক্ষেত্রটিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের বর্তমান সরকার সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই পশুপালন, ডেয়ারি, মৎস্যচাষের মতো প্রাথমিক ক্ষেত্রগুলির উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের গ্রামীণ এলাকার বহু মানুষ গবাদি পশু, হাঁস, মোরগ পালন করে জীবিকা নির্বাহ করছেন এবং প্রাণী পালনকে তাদের আয়ের উৎস হিসেবে পরিগণিত করেছেন।
রাজ্যে প্রাণী পালকদের বিজ্ঞানসম্মত প্রাণীপালনে উৎসাহিত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উন্নত প্রথায় প্রাণী পালনে অল্প সময়ে অধিক উৎপাদন ও রোজগার বৃদ্ধির লক্ষ্যেই প্রাণী পালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এরফলে গ্রামীণ এলাকার মানুষ প্রাণীপালনের মধ্যদিয়ে স্বনির্ভরতার নতুন দিশা খুঁজে পেয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাণীপালন ও ডেয়ারি শিল্পের উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সেই লক্ষ্যে গত প্রায় ৪ বছরে অনেক নতুন প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম একটি প্রকল্প হল ‘মুখ্যমন্ত্রী উন্নত গোধন প্রকল্প’।
২০২০ সালের অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রী এই প্রকল্পের সূচনা করেন। সেক্স সর্টেড সিমেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিম গো প্রজননের মাধ্যমে স্ত্রী বাছুরের সংখ্যা বাড়ানোই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। তাতে রাজ্যে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে গোপালকদের যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা যাবে, পাশাপাশি রাজ্যের চাহিদা অনুযায়ী দুধ রাজ্যেই উৎপাদন করা সম্ভব হবে। মুখ্যমন্ত্রী উন্নত গোধন প্রকল্পে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে সেক্স সর্টেড সিমেন্স প্রযুক্তির মাধ্যমে ১৫ হাজার ৯১৬টি কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে। তাছাড়াও চলতি ২০২১-২২ অর্থবর্ষে এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লক্ষ ৩৩ হাজার ২০০টি কৃত্রিম প্রজনন করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। সাফল্যের হার প্রায় ৯৭ শতাংশ। যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এই প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন তা এই সাফলোর মাধ্যমেই ফুটে উঠেছে।
প্রাণীসম্পদ বিকাশ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে বর্তমানে পশু সম্পদ রয়েছে ১৩ লক্ষ ১৮ হাজার এবং হাঁস সহ পোল্ট্রির সংখ্যা ৪১ লক্ষ ২৪ হাজার। এগুলিই গ্রামীণ এলাকার মানুষের জীবন জীবিকার অন্যতম উৎস। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা ও রোজগার সুনিশ্চিত করতে গবাদি পশু ও পাখির স্বাস্থ্য সুরক্ষায়ও রাজ্য সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। প্রাণী স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ২০২০-২১ সালে ১২ লক্ষ ৪ হাজার গবাদি পশুর এবং ৩৩ লক্ষ হাজার পাখির টিকাকরণ করা হয়েছে। প্রাণী স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে শুধু টিকাকরণই নয়, পশুপাখির চিকিৎসার বিষয়েও দপ্তরের প্রয়াস জারি রয়েছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নয়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পশুপাখির চিকিৎসার জন্য রাজ্যে বর্তমানে ১৬টি পশু হাসপাতাল, ৪৭৩টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ৬০টি ডিসপেনসারি রয়েছে। এছাড়াও পশুপাখির রোগ সনাক্তকরণের জন্য পশ্চিম ত্রিপুরা, গোমতী, ধলাই এবং উত্তর ত্রিপুরায় রয়েছে ডিজিজ ইনভেস্টিগেশন ল্যাব। তথ্য অনুসারে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির মাধ্যমে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লক্ষ ৪৮ হাজার ৭৩০টি গবাদি পশুর এবং ৪০ লক্ষ ১ হাজার ৪৩৪টি পাখির চিকিৎসা করা হয়েছে। রাজ্যে মাংস, ডিম ও দুধের যে চাহিদা রয়েছে, তা পূরণেও দপ্তর বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজ করছে। এরফলে দেখা গেছে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ এই তিন অর্থবর্ষে মাংস, ডিম এবং দুধ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সফলতা এসেছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ ১৯ অর্থবর্ষে রাজ্যে যেখানে দুধ উৎপাদন হয়েছিল ১ লক্ষ ৮৩ হাজার ৫১০ মেট্রিকটন, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২ লক্ষ ৬ হাজার ১৭০ মেট্রিকটন। শুধু দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, দুগ্ধ উৎপাদকদের উৎপাদিত দুধ যাতে কোন অবস্থাতেই নষ্ট না হয় এবং তারা যাতে দুধের নায্যমূল্য পায় তারজন্য রাজ্যে আধুনিকমানের বান্ধ মিল্ক কুলিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। দুধ সংরক্ষণের জন্য রাজ্যে এরকম ৫টি বান্ধ মিল্ক কুলিং স্টেশন বর্তমানে চালু রয়েছে। রাজ্যে মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে শূকর, ছাগল পালন উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ফলে মাংসের উৎপাদনও ধীরে ধীরে বাড়ছে।
দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে রাজ্যে যেখানে মাংসের উৎপাদন হয়েছিল ৪৮ হাজার ৩৯৬ মেট্রিকটন, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে তা বেড়ে হয়েছে ৫২ হাজার ১৮০ মেট্রিকটন। মাংসের উৎপাদন ২০২১-২২ অর্থবর্ষে আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে দপ্তর বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে কাজ করছে। শূকর ও ছাগল পালন উন্নয়ন প্রকল্পে চলতি অর্থবর্ষে প্রাণী পালকদের মধ্যে ১,৫০০ ইউনিট সংকর প্রজাতির শূকরছানা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী স্বনির্ভর পরিবার যোজনায় এ অর্থবর্ষে ৫,৮০০ ইউনিট শূকর এবং ২,৯০০ ইউনিট ছাগল প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েত ও এডিসি ভিলেজগুলিতে নির্বাচিত সুবিধাভোগী পরিবারগুলিকে এই কর্মসুচির আওতায় আনা হয়েছে। রাজ্যে শূকর পালন উন্নয়নের জন্য গ্রেট ব্রিটেন থেকে ৫৪টি সাদা ইয়র্কশায়ার প্রজাতির শূকর ছানা আনা হয়েছে, যা বর্তমানে দেবীপুর ফার্মে রয়েছে। সিপাহীজলা জেলায় একটি শূকর প্রজনন ফার্ম স্থাপন করার পরিকল্পনাও নিয়েছে দপ্তর। এরজন্য খরচ হবে ২ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা৷ এছাড়াও ২০২১-২২ অর্থবর্ষে অমরপুরের থাকছড়ায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে পিপিপি মডেলে একটি শূকরের খামার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রাজ্যে ডিমের যে চাহিদা রয়েছে তা পূরণ করার লক্ষ্যেও প্রাণীসম্পদ বিকাশ দপ্তরের প্রয়াস জারি রয়েছে। ফলে রাজ্যে ডিমের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। ডিম উৎপাদন ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে যেখানে ছিল ২৭ কোটি ৬০ লক্ষ, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে সেই উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৩০ কোটি ২৪ লক্ষ। রাজ্যে পোল্ট্রি এবং হাঁস পালন ক্ষেত্রটি উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজ্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়াও রুদ্রসাগরের পার্শ্ববর্তী স্থানে বসবাসকারী গরিব অংশের জনগণের আর্থিক মানোন্নয়নে রুদিজলা প্রকল্পে হাসের ছানা বিতরণ করা হয়েছে। রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশেই রাজ্য সরকার উন্নয়নের প্রাথমিক ক্ষেত্র হিসাবে প্রাণী সম্পদকে চিহ্নিত করে বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়িত করছে। যা আগামীদিনে রাজাকে স্বনির্ভর করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।