অনলাইন ডেস্ক, ২১ জানুয়ারি।। সংবাদমাধ্যমের অনেকটাই এখন দখল করে নিচ্ছে নিউজ পোর্টাল– ইউটিউবের মতো আধুনিক প্রযুক্তিগত মাধ্যম। প্রতি মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে খবরের আপডেট। নিউজ চ্যানেলগুলিও রয়েছে স্বমহিমায়। ফলে প্রিন্ট পত্রিকার পরিধি অনেকটাই ছোট হয়ে আসছে। যদিও সকীয়তার জন্য ছাপা সংবাদপত্রগুলি এখন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে টিকে রয়েছে। ঠিক এই সময়ে হাতে লেখা একটি দৈনিক সংবাদপত্র এখনও বহাল তবিয়তে নিজের জায়গায় অবস্থান করছে তার চাহিদা বা জনপ্রিয়তা একটুও টলেনি।
শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি ‘দ্য মুসলমান’ নামের উর্দুভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রটি এখনও নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে। দেশের বাকি সব উর্দু সংবাদপত্র বা পত্র-পত্রিকা আধুনিক প্রযুক্তিতে ছাপা হলেও ‘দ্য মুসলমান’ বিগত ৯৪ বছর ধরে তার আগের ধারাই বজায় রেখেছে। চেন্নাই থেকে প্রকাশিত এই সংবাদপত্রটি প্রথমে হাতে লিখেই ‘অক্ষর বিন্যাস’ করা হয়। ঠিক যেভাবে ৯৪ বছর আগে কাগজ ছাপা হত– এখনও সেই ধারা অব্যাহত। এতে আধুনিক প্রযুক্তির ঝকঝকে-রঙিন ছাপার যুগে বিন্দুমাত্র কমেনি ‘দ্য মুসলমান’-এর জনপ্রিয়তা। চার পাতার সংবাদপত্রটির এখনও গ্রাহক সংখ্যা একুশ হাজার।
ভারতে উর্দু সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ সঈদ আজমাতুল্লাহ ১৯২৭ সালে ‘দ্য মুসলমান’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশ শুরু করেন। উর্দুভাষী মুসলিমদের নবজাগরণের লক্ষ্যে এবং মুসলিম সমাজের মুখপত্র হিসেবে তিনি পত্রিকাটি সম্পাদনা শুরু করেন। পত্রিকাটির নামলিপি বা টাইটেল হেডে রয়েছে পবিত্র কুরআনের আয়াত ইরশাদ হয়েছে– অতএব হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরা ‘তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো’।
সঈদ আজমাতুল্লাহর ইন্তেকালের পর পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন তাঁর পুত্র সঈদ ফাজলুল্লাহ। ২০০৮ সালে দায়িত্ব বর্তায় ফাজলুল্লাহ’র নাতি সঈদ আরিফুল্লাহ’র কাঁধে। তিনি এখন পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ ‘দ্য মুসলমান’কে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।
উর্দুভাষী মুসলিম সমাজের মুখপাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও দ্য মুসলমান সব ধরনের সংবাদই প্রকাশ করে থাকে। পত্রিকাটির বিশেষত্ব হল– পুরোটাই হাতে লেখা। কোনও লেখার মধ্যে পার্থক্য নেই– একই ধাঁচের হাতের লেখা। পত্রিকা নকশা– কলাম বিভাজনকে সমান রেখে তিনশোর বেশি অনুলিপিকার প্রতিদিন ২১ হাজার পত্রিকায় লিখে চলেছেন। প্রতি কপি পত্রিকার মূল্য ১ টাকা। করোনা মহামারির প্রকোপের মধ্যেও বন্ধ হয়নি ‘দ্য মুসলমান’ এর প্রকাশনা।
ইন্টারনেটের যুগেও জনপ্রিয়তা কমেনি হাতে লেখা পত্রিকাটির। শতবর্ষের দোরগোড়ায় পৌঁছলেও শ্রীবৃদ্ধি হয়নি ‘দ্য মুসলমান’ পত্রিকার। চেন্নাই শহরে মাত্র ৮০০ বর্গফুটের অফিসে কাজ করেন মাত্র তিনজন রিপোর্টার ও তিনজন ‘কাতিব’ বা লিপিকার। এরপর আছে অনুলিপিকার। এঁদের কাজ একই খবরকে বারবার প্রতিটি কাগজে লিখে যাওয়া। প্রধান লিপিকার রহমান হুসাইনির সঙ্গে সহযোগিতা করেন শাবানা বেগম ও খুরশিদা বেগম। ‘পুবের কলম’কে শাবানা বেগম টেলিফোনে জানান– এই পদ্ধতিতে অনুলিপিকারের কাজটা সবথেকে কঠিন। কারণ এই পদের কর্মীদের দায়িত্ব থাকে– একই হাতের লেখায় একই মাপে সবকটি কাগজে খরচ ধরানো। চার পৃষ্ঠার জন্য সব লেখা ও সংবাদ নিজেই নির্বাচন করেন বলে দাবি সম্পাদক সঈদ আরিফুল্লাহ’র।
জানা গিয়েছে– প্রতিদিন সকাল ১০টায় পত্রিকার কাজ শুরু হয়। সকালে দু’জন অনুবাদক এসে খবরগুলি উর্দুতে অনুবাদ করেন। এর পরবর্তী দুই ঘণ্টায় তিনজন লিপিকার ব্রডশিটে বিশেষ কলম ও কালি ব্যবহার করে সেটা লিখে ফেলেন। চার পৃষ্ঠার মধ্যে প্রথম পৃষ্ঠায় থাকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় এবং অন্য দুই পৃষ্ঠায় অন্যান্য স্থানীয় সংবাদ ও বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়। তবে সোমবারের আয়োজন একটু ভিন্ন হয়। সেদিন তৃতীয় পৃষ্ঠায় কুরআন ও ইসলামি লেখা প্রকাশিত হয়। একইভাবে হাতে লেখা পদ্ধতিতে পত্রিকা প্রকাশের দীর্ঘ যাত্রাপথে ‘দ্য মুসলমান’ পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত।
পত্রিকা সম্পাদকের কথায়– উর্দু ভাষাচর্চা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ক্যালিগ্রাফি লেখার লোকও ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ! ফলে এইভাবে নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করতে ভবিষ্যতে লেখার জন্য যোগ্য ‘কাতিব’ পাওয়া যাবে কি না– তা নিয়েও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন সঈদ। এর সঙ্গে রয়েছে পত্রিকার উপার্জন– আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ। তা সত্ত্বেও নবীন প্রজন্মের কাছে উর্দু লেখা এবং পড়ার অভ্যাস বজায় রাখার জন্যই এখনও হাতে লিখে রোজ ‘দ্য মুসলমান’ প্রকাশ করেন বলে দাবি করেন সঈদ সাহেব।