অনলাইন ডেস্ক, ৭ জানুয়ারি|| মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সারা দেশে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। যে গতিতে এই বিক্ষোভ ছড়িয়েছে তাতে স্থানীয় এবং আঞ্চলিকভাবে অনেকেই অবাক হয়েছেন, এবং বিভিন্ন ইঙ্গিত থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই বিক্ষোভ নিছক জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে নয়।
বিক্ষোভ শুরু হয় যখন তেল-সমৃদ্ধ সাবেক এই সোভিয়েত রাষ্ট্রের সরকার তরলায়িত জ্বালানি গ্যাস বা এলপিজির মূল্যের ওপর বেঁধে দেয়া সীমা বাতিল করে। এর ফলে এলপিজির দাম বেড়ে যায়।
কাজাখস্তানের অনেকেই তাদের গাড়িতে এলপিজি ব্যবহার করেন।
রবিবার এই বিক্ষোভ শুরু হয় একটি জায়গায়। কিন্তু মঙ্গলবারের মধ্যে এটি সারা দেশের শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় জনসমাবেশ হয়, এবং সেখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
কাজাখস্তানের প্রধান শহর ও সাবেক রাজধানী আলমাতিতে হাজারখানের লোক জড়ো হলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাস এবং স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করে। এতে বিক্ষোভকারী ও পুলিশসহ শত শত লোক আহত হয়।
এরপর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলে কাজাখস্তানের বহু জায়গায় জরুরি আইন জারি করা হয়। অনেক জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় বলে খবর পাওয়া যায়।
প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ এই বিক্ষোভের জন্য তার নিজের সরকারকেই দায়ী করেন এবং প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো সরকারকে বরখাস্ত করেন।
তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে ‘দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে’ এলপিজির দাম কমানো হবে।
কিন্তু জনগণ তাতে শান্ত হয়নি। তারা আলমাতির মেয়রের অফিসে ঢুকে ভাঙচুর চালায় এবং সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এই বিক্ষোভ কেন অস্বাভাবিক?
কাজাখস্তানে প্রচুর তেল এবং গ্যাস রয়েছে। পুরো মধ্য এশিয়ায় দেশটিকে খুব প্রভাবশালী বলে মনে করা হয়। এর কারণ, ঐ অঞ্চলের মোট জিডিপির শতকরা ৬০ ভাগ যোগ দেয় কাজাখস্তান। কিন্তু এই দেশটির সরকারকে খুবই কর্তৃত্ববাদী বলে মনে করা হয়।
কাজাখস্তান বিশ্বের নবম বৃহৎ দেশ। কিন্তু সেই বিবেচনায় দেশের জনসংখ্যা খুবই কম – এক কোটি ৮৮ লক্ষ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেশটি ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। দেশটি যখন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ তখন ১৯৮৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন নুর-সুলতান নজরবায়েভ। তখন থেকে দীর্ঘদিন ধরে তিনি কাজাখস্তানের শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখেন।
এরপর এক নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হন, যে নির্বাচনে কেউ তাকে কার্যত চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি।
তার শাসনামলে নজরবায়েভ কাজাখস্তানে ব্যক্তিপূজা চালু করেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। এমনকি, তিনি একটি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন এবং নিজের নামে তিনি এই রাজধানীর নাম রাখেন নুর-সুলতান।
বহু বছর শাসনের পর নজরবায়েভ ২০১৯ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। সে সময় তার বিরুদ্ধে বিরল এক গণবিক্ষোভ হয়েছিল। ধারণা করা হয় এই পদত্যাগের মাধ্যমে তিনি পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন।
একই বছর হঠাৎ করে ডাকা এক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন নজরবায়েভের পছন্দের প্রার্থী কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ। ঐ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক প্রবল সমালোচনা করেন।
ক্ষমতায় না থাকলেও নজরবায়েভ এখনও খুবই প্রভাবশালী, এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যে বিক্ষোভ চলছে তা মূলত নজরবায়েভের বিরুদ্ধেই।
কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেছেন তিন বছর হলো। এই তিন বছরে কাজাখস্তানের বিশেষ কোন উন্নয়ন হয়নি। সে দেশে জীবনমান এখনও কম। কাজাখদের ব্যক্তি স্বাধীনতাও খুবই সীমিত।
লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষক কেট মলিনসন বিবিসিকে বলছেন, ‘কাজাখস্তানের জনগণের সঙ্গে নজরবায়েভের একধরনের সখ্যতা ছিল। মানুষ ছিল সরকার অনুগত। কারণ তারা দেখছিল তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে’।
‘কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। গত দুবছরে কোভিড মহামারির সময় কাজাখস্তানে ব্যাপক মূদ্রাস্ফীতি ঘটে’।
আর এলপিজির মূল্য বাড়ানোর পর জনগণের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়।
বিক্ষোভকারীরা কী চায়?
সরকার বরখাস্ত হলেও এবং জ্বালানির দাম আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হলেও রাস্তা থেকে বিক্ষোভকারীদের সরে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট নজরবায়েভের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তারা বুঝতে পেরেছেন যে সরকারে পরিবর্তন ঘটলেও অনেক সময় পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে না।
যে প্রশ্নটি এখন দেশের সব জায়গায় উঠছে, তা হলো- ‘গত ৩০ বছরে সরকার আমাদের জন্য কী করেছে?’
এই বিক্ষোভের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ঝানাওজেন। এটি কাজাখস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমে মংগিস্টু প্রদেশের একটি শহর।
২০১১ সালে এই শহরটিতে বড় ধরনের একটি বিক্ষোভ হয়েছিল। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে তেল শিল্প কর্মীদের এই বিক্ষোভটি কঠোর হাতে দমন কর হয়, এবং এতে অন্তত ১৪ জন প্রাণ হারায়। আহত হয় শতাধিক মানুষ।
এখন ঝানাওজেন আবার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এবং সেখানকার বিক্ষোভকারিরা পাঁচ-দফা দাবিনামা পেশ করেছেন:
১. সরকারের মধ্যে প্রকৃত পরিবর্তন।
২. সরাসরি ভোটের মাধ্যমে প্রাদেশিক গভর্নরদের নির্বাচন। (বর্তমানে প্রেসিডেন্ট এদের নিয়োগ করেন। )
৩. ১৯৯৩ সালের সংবিধান ফিরিয়ে আনা। ঐ সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় কাটছাঁট করা হয়েছিল।
৪. রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কারও ওপর নির্যাতন চলবে না।
৫. সরকারের সাথে সম্পর্ক নেই এমন ব্যক্তিদের সরকারে স্থান দেয়া।
কিন্তু এখনকার আন্দোলন বিক্ষোভে কে নেতৃত্ব দিচ্ছে তা এখনও পরিষ্কার না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কাজাখস্তানে আসলে নির্বাচন-ভিত্তিক গণতন্ত্র নেই, কারণ বহু দশক ধরে সে দেশে ভিন্নমত তৈরি হলে সেটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হতো।
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক গ্রিগরি গোলোসোফ বলছেন, কাজাখস্তানের মানুষ বিশ্বাস করেন যে একমাত্র সড়কে বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে তারা সরকারকে তাদের কথা শুনতে বাধ্য করতে পারবেন।
‘যে দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার সেখানে যে কোন অ-জনপ্রিয় অর্থনৈতিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করা’।
তাহলে কী ঘটতে চলেছে?
কাজাখস্তানের পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বিক্ষোভকারিরা সড়ক ছাড়ছে না। কিন্তু পুলিশ এখনও কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সরকারও কোন মারাত্মক পদক্ষেপ না নিয়ে সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করছে।
‘মনে হচ্ছে তোকায়েভ উদার মনোভাব বজায় রেখে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। তবে এই কৌশল কতখানি কাজ করবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে,’ বলছেন গ্রিগরি গোলোসোফ।
এনিয়ে বিবিসির সঙ্গে আরেকজন বিশ্লেষক কথা বলেছেন। তিনি হলেন মস্কো কার্নেগী সেন্টারের অ্যালেকজান্ডার বৌনফ। তবে তার মত ভিন্ন।
তিনি বলছেন, কাজাখস্তান পশ্চিমা দেশের কোন মিত্র নয়। এর ফলে পশ্চিমা দেশের নেতারা একে ‘নিপীড়ন-বাদী এক সরকারের বিরুদ্ধে এক গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান’ হিসেবে ধরে নিতে পারেন।
‘এই বিক্ষোভের বিরুদ্ধে কাজাখ সরকারের কোন পদক্ষেপ না নেয়া খুব কঠিন। আর এই আন্দোলনকে সমর্থন না করারও কোন উপায় পশ্চিমা নেতাদের নেই। তবে দীর্ঘমেয়াদে এসব প্রতিবাদের ফলে কাজাখ সরকার রাশিয়ার প্রতি আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়বে’।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষণা ফেলো ডায়ানা কুদাইবার্জেনোভা বলছেন, কাজাখ সরকার যে শান্তিপূর্ণভাবে এই সঙ্কট মোকাবেলার চেষ্টা করবে, এমন ইংগিতই পাওয়া যাচ্ছে।
‘শান্তিপূর্ণভাবে এর সমাধানের একটা পথ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট অন্তত কিছু বিক্ষোভকারীর সাথে মুখোমুখি আলোচনায় বসবেন এবং জনগণ দেখতে পাবে যে তাদের কথা সরকারের কানে ঢুকেছে’।
একটি প্রধান গ্যাস, তেল এবং খনিজ রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের আস্থার ব্যাপারটাও কাজাখস্তানকে মনে রাখতে হবে। এটা করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ধরে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
একই সঙ্গে সে দেশের জনগণ সাবেক প্রেসিডেন্ট নজরবায়েভের ছায়া থেকে বের হতে না পেরে দৃশ্যত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এবং এই অবস্থা পাল্টানোর জন্য তারা লড়াই করতে প্রস্তুত।
কাজাখস্তানের এসব গোলযোগের প্রভাব ঐ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতেও পড়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, এই গণবিক্ষোভ কাজাখস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ এবং ‘আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে’ বলে তারা আশা করে।
তবে রুশ সরকারি সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ‘পশ্চিমা শক্তি’র মদতেই কাজাখস্তানে এসব বিক্ষোভ চলছে।