স্টাফ রিপোর্টার, আগরতলা, ৯ ডিসেম্বর।।
রাজ্যে শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশে বহুমুখী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শিল্পবান্ধব ও বিনিয়োগ উপযোগী পরিমণ্ডল সুনিশ্চিতকরণে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করছে সরকার। শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশে গুচ্ছ সুযোগ সম্প্রসারণের পাশাপাশি বেশ কিছু ক্ষেত্রে আনা হয়েছে সরলীকরণ।
আজ প্রজ্ঞাভবনে ডেস্টিনেশন ত্রিপুরা- ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২১’র উদ্বোধন করে একথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। উল্লেখ্য, রাজ্যে এই প্রথম এ ধরনের বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। ইনভেস্টমেন্ট সামিটের উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, বিনিয়োগকারীদের সুবিধার জন্য রাজ্যে শিল্প পরিকাঠামোর অনুকূল পরিবেশ ও বাণিজ্যিক নিরাপত্তা প্রদানে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করছে সরকার।
গতানুগতিক বাণিজ্যের উর্ধ্বে উঠে সঠিক শিল্পক্ষেত্রের চয়ন ও তাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে উদ্ভাবনী এবং নতুন নতুন পন্থায় শিল্প বিকাশের বিশাল সুযোগ রয়েছে রাজ্যে। রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনাময় দিকগুলি ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে বিনিয়োগ করার লক্ষ্যে শিল্পপতিদের আহ্বান করেন মুখ্যমন্ত্রী। ইনভেস্টমেন্ট সামিটের দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের সাথে মতবিনিময়ও করেন মুখ্যমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে সঠিক ব্যবস্থাপনায় কার্য সম্পাদন এবং পরিকল্পনা রূপায়ণের দ্রুততার নিরিখে বেসরকারি ক্ষেত্রগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে রাজ্য সরকার। পূর্বোত্তরের রাজ্য হিসেবে ত্রিপুরায় পৌঁছে যাওয়া প্রথম সূর্যকিরণের মতো বাণিজ্যিক সূর্যোদয়ের উপরও মুখ্যমন্ত্রী গুরুত্ব আরোপ করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, গতানুগতিক বাণিজ্য প্রবণতার বাইরে ত্রিপুরার বিভিন্ন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে আত্মপরিচিতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা সম্ভব।
শিল্পের প্রসার ও বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে রাজ্য সরকার। শিল্প বিকাশে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ও শিথিলতা সরলীকরণ ও এনেছে রাজ্য সরকার। ক্ষুদ্র থেকে ভারী শিল্প সমস্ত ক্ষেত্রের বিকাশে গুচ্ছ পরিকল্পনা সফলভাবে রূপায়িত হচ্ছে। গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সরকারি কাজেও দ্রুততা আনার লক্ষ্যে। শিল্পক্ষেত্রের বিকাশে বর্তমানে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কার্যক্ষেত্রে রূপায়িত হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে ইতিমধ্যেই উদ্ভাবনী ভাবনায় বিভিন্ন যুব উদ্যোগী সহ সাফল্যের নিরিখে ত্রিপুরা সর্বত্র পরিচিতি লাভ করছে।
নীতি আয়োগের তথ্য অনুসারে দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম দিকে উঠে এসেছে ত্রিপুরা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরায় সূচনা হতে চলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক সম্ভাবনার বিকাশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবায় রাজ্য সরকারের তরফে ভর্তুকি সহ বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আন্তরিকতায় ত্রিপুরার উন্নয়ন গতিকে কোনোভাবেই রোখা সম্ভব নয়। আইটি সেক্টর, ডাটা সেক্টর সহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রের বিকাশে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে রাজ্য সরকার।
অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বলেন, প্রধানমন্ত্রী । নরেন্দ্র মোদী উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে অষ্টলক্ষ্মী বানানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলিতে বিনিয়োগ, যোগাযোগ, পরিকাঠামো তথ্য প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজ করছে কেন্দ্রীয় সরকার। দেখা গেছে বিগত কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘ সময়কালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপেক্ষিত ছিল।
কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, উত্তর- পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির উন্নয়নের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হতো তার অপবায় করা হতো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সার্বিক উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তিনি বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির মধ্যে ত্রিপুরা যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিল্প, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে চলছে।
মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের নেতৃত্বে বর্তমান রাজ্য সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর রাবার, স্বাস্থ্য, কৃষি, পর্যটন, শিল্প, যোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। রাজ্য সরকার এই ক্ষেত্রগুলির উন্নয়নে রাজ্য বাজেটেও অর্থ বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। ত্রিপুরা সরকার নিয়ম, নীতি ও নিয়ত এই তিনটি বিষয়ে প্রধান্য দিয়ে রাজ্যবাসীকে স্বচ্ছ প্রশাসন উপহার দিয়েছে। জনগণকে স্বাস্থ্য, ঘর, শিক্ষা, বিদ্যুৎ পরিষেবা প্রদানে রাজ্য সরকার স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছে। ত্রিপুরা সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের যে সঠিক দিশায় চলছে তার চিত্র সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পুর ভোটের ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে। পুরভোটের ফলাফলের পর ত্রিপুরা এখন ডাবল ইঞ্জিন সরকারের পরিবর্তে ত্রিপল ইঞ্জিন সরকারে পরিণত হয়েছে। ফলে রাজ্যের উন্নয়নের গতি আরও বৃদ্ধি পাবে বলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীগোয়েল আরও বলেন, রাজ্যের বিগত সরকার ৩০-৩৫ বছর ধরে ত্রিপুরাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বর্তমান রাজ্য সরকার গত ৪ বছর ধরে সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে ত্রিপুরাকে আদর্শ রাজ্যে পরিবর্তিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। ত্রিপুরা বর্তমানে সড়ক, বিমান, রেল যোগাযোগের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে। তিনি বলেন, ত্রিপুরা রাবার উৎপাদনে দেশের মধ্যে বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আগামী ৫ বছরে ত্রিপুরায় ৩০ হাজার হেক্টর এলাকায় রাবার চাষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরফলে ত্রিপুরায় রাবার ভিত্তিক শিল্প স্থাপনে খুবই সহায়ক হবে। ত্রিপুরার উৎপাদিত কাঁঠাল ও আনারস বর্তমানে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে। ত্রিপুরার হন্ততাঁত ও হস্তকারু শিল্পের উৎপাদিত সামগ্রী এখন পুরো দেশেই প্রসিদ্ধ। সারুমে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে ত্রিপুরা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির জন্য বাণিজ্য দ্বারে পরিণত হবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। কেন্দ্রীয়মন্ত্রী বলেন, বর্তমান ত্রিপুরা সরকার শিল্প স্থাপনের জন্য উদ্যোগপতিদের উৎসাহিত করতে সিঙ্গেল উইন্ডো চালু করেছে ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ৫০% ছাড় দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ত্রিপুরায় শিল্প স্থাপনের জন্য উদ্যোগীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শ্রীগোয়েল।
অনুষ্ঠানে রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী মনোজ কান্তি দেব বলেন, ত্রিপুরা ছোট রাজ্য হলেও বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। সেইসব প্রাকৃতিক সম্পদকে ভিত্তি করে রাজ্যে শিল্প স্থাপনে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে রাজ্য সরকার। বেশি করে শিল্প স্থাপন হলে রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন হবে তেমনি ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, শিল্প স্থাপনের জন্য যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা প্রয়োজন তা সবগুলিই রাজ্যে রয়েছে। রাজ্যে প্রচুর পরিমাণে আনারস, বাঁশ, কাঠাল, চা, রাবার ইত্যাদি উৎপাদন হয়। সেগুলিকে ভিত্তি করে রাজ্যে শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসার জন্য উদ্যোগপতিদের প্রতি আহ্বান জানান মন্ত্রী। রাজ্যে শিল্প স্থাপনে রাজ্য সরকারও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এছাড়াও বক্তব্য রাখেন ত্রিপুরা শিল্প উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান টিংকু রায়, শিল্প ও বাণিলা দপ্তরের সচিব ড. প্রশান্ত কুমার গোয়েল, নাবার্ডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার শাব্দি কে. ভি.রাবার বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. সাওয়ার ধানানিয়া, মুখ্য প্রধান বন সংরক্ষক ডি কে শর্মা এবং ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি প্রদীপ সুরেখা।