।। রক্ষিত দেববর্মা ।। কোভিড-১৯ জনিত সংকট সারা দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে অকল্পনীয় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামের শিশুরা যাদের কাছে আধুনিক প্রযুক্তি ও গ্যাজেট সংযোগের সুবিধা নেই। শহর এলাকার অনেকেই ডিজিটাল শিক্ষার পথ বেছে নিয়েছে যেহেতু তারা বুঝতে পেরেছে বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের সাথে সংযোগ বজায় রাখার এটাই একমাত্র পন্থা।
দেশের বহু প্রাকপ্রাথমিক বিদ্যালয় ও বিদ্যালয় এক বছরের উপরে বন্ধ হয়ে রয়েছে। বহু বিদ্যালয় তাদের সাধ্যমত শিক্ষার সরঞ্জাম সরবরাহ করার চেষ্টা করেছে এবং শিশুদের অভিভাবকরাও সাধ্যমত চেষ্টা করেছে শিশুদের শিক্ষা প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য। তা সত্বেও এখনো এজাতীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে বহু লোকের সন্দেহ ও অভিযোগ রয়েছে যে এই ব্যবস্থা খুব একটা ফলপ্রসূ বা সমভাবে ফলপ্রসূ নয়।
তাই সারা দেশের বিদ্যালয়, পরিবার ও নীতি নির্ধারকরা শিশুদের শিক্ষার ঘাটতি ও সামাজিক শিক্ষাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন।
কোভিড পরিস্থিতিতে যেসব শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে তারা এই পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। প্রাকপ্রাথমিক বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষা থেকেও অনেকে বঞ্চিত হয়েছে। আধিকারিকদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় গ্রামীণ এলাকার ষষ্ঠ শ্রেণীর অর্ধেকের বেশি শিশু দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠ্যবই পড়তে পারে না অথবা সাধারণ অংকের সমাধান করতে অক্ষম।
এই পরিস্থিতিতে ত্রিপুরা সরকার উপলব্ধি করেছে যে, এখনোই শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ এক নতুন উপায়ে খেলার ছলে শুরু করতে হবে। এইভাবে নতুন দিশা প্রকল্পের আওতায় ২২ আগস্ট, ২০২১ থেকে ‘ক্যাচ আপ ক্যাম্পেইন’ নামে একটি কর্মসূচি শুরু করা হয়েছে। সরকারি বিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে বুনিয়াদী শিক্ষা দপ্তর এই কর্মসূচি তৈরী করেছে। উদ্দেশ্য হল শিশুরা যাতে ভাষা ও বুনিয়াদি অংক সংক্রান্ত শিক্ষায় তাদের দক্ষতাকে উন্নত করতে পারে। সেজন্য তাদের পঠন ও অংক সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে বাড়ানোর প্রচেষ্টা করা হচ্ছে।
ক্যাচ আপ ক্যাম্পেইন-এ শিশুদের সাথে তাদের মা বাবারাও যোগ দিচ্ছেন খেলার ছলে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জনে তাদের মনোযোগ বাড়ানোর জন্য।
যাতে করে শিশুদের পঠন পাঠন ও অংক সংক্রান্ত দক্ষতা সৃষ্টি করা যায় বা পুনরায় আগ্রহী করা যায়। এই কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে শান্তিরবাজার মহকুমার বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিস থেকে পারিবারিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষাগত উন্নয়নে সহায়তার চেষ্টা করা হচ্ছে।
যেমন, বিভিন্ন ম্যাসেজ পরিবারের ফোনে ম্যাসেজ হিসেবে পাঠানো হচ্ছে। পরিবারের সাথে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাগত উন্নয়ন সম্পর্কে কথাবার্তা চালু রাখছে ও বিভিন্ন তথ্যাদি সরবরাহ করছে। তাছাড়া শিক্ষকরা প্রতিদিন শিশুদের ছোট ছোট দলের সঙ্গে সরাসরি এক থেকে দেড় ঘন্টার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছেন, রিডিং কিটের সাহায্যে নির্দেশমূলক কার্যকলাপ ও প্রদর্শনমূলক শিক্ষায় যুক্ত করছেন।
গ্রামসভার মাধ্যমে পঞ্চায়েত ও স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদেরও এ সম্পর্কে জানানো হচ্ছে। বিদ্যালয় পরিদর্শক প্রণব সরকার জানালেন, “এই ক্যাচ আপ ক্যাম্পেইনকে আরও বেশি ছড়িয়ে দেওয়া ও বেশি দিনের জন্য চালু রাখা দরকার, কমপক্ষে এক বছরের জন্য। তিনি বলেন, তিনি সবসময়ই সমাজের কল্যাণে কিছু কাজ করতে ইচ্ছুক এবং এই ক্যাচ আপ ক্যাম্পেইন’-এ অংশগ্রহণ করতে পেরে তিনি আনন্দিত।
শান্তি কলোনী এস বি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র অনুপ ত্রিপুরা। তার মা-বাবা দিন মজুরের কাজ করে সংসার চালান। অনুপ জানালো সে বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হতে চায়। ক্যাচ আপ ক্যাম্পেইনে অনুপ ত্রিপুরা পড়াশোনায় খুব ভালো সাফল্য দেখাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, উপযুক্ত সুযোগ পেলে কম সময়ের মধ্যেই শিশুরা অভাবনীয় সাফল্য দেখাতে পারে। ক্যাচ আপ ক্যাম্পেইনের রিসোর্সপার্সন জনার্ধন নমঃ এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পেরে আনন্দিত।
তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন শিশুরা আমাদের দেখতেই ঘিরে ধরে রিডিং কিটগুলি দেখার জন্য যে আমরা তাদের জন্য কি নিয়ে এসেছি। প্রতিদিনই তারা নতুনভাবে উৎসাহিত হয়। ক্যাচ আপ ক্যাম্পেইনে পড়ার সুযোগ পেয়েছে এমন এক ছাত্রের মা মমতী শীল জানালেন, এ ধরনের কর্মসূচি নির্দিষ্ট মেয়াদের পরও চালু রাখা দরকার। কেননা এতে শিশুদের শিক্ষার জন্য এক নতুন দিক খুলে গেছে।এমনকি দরিদ্র পরিবারের শিশুরাও তার সুযোগ পাচ্ছে।
ক্যাচ আপ ক্যাম্পেইন কর্মসূচির কাজকর্মের নজরদারি ও মূল্যায়নের জন্য প্রণব সরকারের নেতৃত্বে বিদ্যালয় পরিদর্শক অফিস থেকে নিয়মিতভাবে বিদ্যালয়গুলি পরিদর্শন করা হচ্ছে। শিশুরা কি ধরণের অগ্রগতি দেখাচ্ছে সে সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া হয়।
শান্তিরবাজার বিদ্যালয় পরিদর্শক অফিসের অধীনে শান্তিরবাজার মহকুমার ৬১টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৪টি বিদ্যালয় নন রিডার ফ্রি ক্যাটাগরিতে রয়েছে। তাই শিক্ষা প্রক্রিয়া যখন পুনরায় চালু হয় তখন হারানো সুযোগকে সময়ের সাথে তাল মেলাতে ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা করা খুবই প্রয়োজন।
তাদেরকে সহায়তা করা নিশ্চিত করা প্রয়োজন কারণ যে সময় তারা পেরিয়ে এসেছে, বিদ্যালয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে সেটা ছাত্রছাত্রীদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যাতে করে ছাত্রছাত্রীরা স্বাভাবিক পাঠ্যক্রমে নিজেদের স্থান খুঁজে পায়। যেন কোন ছাত্রছাত্রী শিক্ষা প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে না পড়ে।