Smart City: রাজন্য স্মৃতি বিজড়িত আগরতলা শহর স্মার্ট সিটি মিশনে অত্যাধুনিক রূপে গড়ে উঠছে

।। মানিক মালাকার ।। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আধুনিকতা, পরিচ্ছন্নতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধ নিয়েই একটি শহর ইতিহাস খ্যাতি অর্জন করে। আমাদের আগরতলা শহর শুধু সুপ্রাচীনই নয় তার একটা ঐতিহ্যময় ইতিহাসও রয়েছে। ইতিহাসের সেই সাক্ষ্য বহন করছে উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ।

রাজনাস্মৃতি বিজড়িত আগরতলা শহর এখন স্মার্ট সিটি মিশনে অত্যাধুনিক রূপে গড়ে উঠছে। প্রায় ১৮৩ বছরের প্রাচীন এই শহরকে আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন রূপ দেওয়ার কাজ চলছে। যার পোষাকি নাম দেওয়া হয়েছে স্মার্ট সিটি মিশন।

১৮৩৮ সালে মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য যে শহরের পত্তন করেছিলেন, সময়ের হিসাবে তার বয়স প্রায় ১৮৩ বছর। তবে ১৮৭৪ সাল থেকে পুর প্রশাসনিক কাঠামোর সূচনা ধরলে এই শহরের বয়স এখনও ১৫০ বছর হয়নি। মূলত মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুরের সময়কাল থেকেই আগরতলা নতুন করে সাজতে থাকে। তারপরের অনেক ইতিহাস।

রাজন্য যুগের অবসানের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় রাজধানী আগরতলার বিস্তার ঘটে। সময়ের সাথে সাথে চাহিদা অনুসারে পরিবর্তন ঘটাই স্বাভাবিক। নাগরিক জীবনকে আরো সুবিধামুখী করে তুলতে বিভিন্ন সময়ে নানা পদক্ষেপ নিলেও গত তিন বছর ধরে আগরতলা শহর যেন ক্রমশ আধুনিক হয়ে উঠছে। চোখে পড়ছে আধুনিক ছোঁয়া। সেজে উঠছে শহর আগরতলা। একটি শহরের সৌন্দর্য নির্ভর করে সেই শহরের পথঘাট, পুকুর, জলাশয় এবং প্রাকৃতিক নানা উপাদানের সৌন্দর্য্যায়নের উপর।

স্মার্ট সিটি মিশনের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে নাগরিক জীবনের চাহিদা অনুসারে সুবিধা এবং পরিষেবা প্রদানের পাশাপাশি শহরকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা। দেশের বিভিন্ন শহরের পরিকাঠামোর উন্নয়নের মাধ্যমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং নাগরিক সুবিধাযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালের ২৫ জুন স্মার্ট সিটি মিশনের সূচনা করেন। ধীরে ধীরে পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয় স্মার্ট সিটি মিশনের কাজ।

মোট ৭৫টি কাজের জন্য ব্যয় ধরা হয় ১,০৩৭৮০ কোটি টাকা। স্মার্ট সিটি বলতে বোঝায় পরিকাঠামো এবং পরিষেবার উন্নয়ন। যা মানুষের নাগরিক জীবনের প্রত্যাশা পুরণে সহায়ক। প্রাতিষ্ঠানিক, বাস্তবিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক এই চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে স্মার্ট সিটি গড়ে উঠে । স্মার্ট সিটি মিশন হচ্ছে ভারত সরকারের বিভিন্ন শহর উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক এক কর্মসূচি।

 

এই কর্মসূচিতে দেশের ১০০টি শহরকে দীর্ঘস্থায়ী ও নাগরিক কেন্দ্রিক স্মার্ট সিটি রূপে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগরতলা শহর তার মধ্যে অন্যতম। আগরতলা শহরে যে কয়টা উল্লেখযোগ্য জলাশয় বা দীঘি রয়েছে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম হলো উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদের সামনে দুপাশে রাধাসাগর ও কৃষ্ণসাগর।

একটু অদূরেই ডিমসাগর মেলারমাঠের দীঘি আর মঠচৌমূহনী বাজার পেরিয়ে কামার পুকুর। লালবাহাদুর ক্লাব সংলগ্ন দীঘি। কুমারীটিলায় রয়েছে একটি বড় জলাশয়। খেজুরবাগানে রাণীর পুকুর। শহরের জলাশয়গুলি আমাদের সম্পদ। এইসব প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করা, পরিচর্যা করা এবং নাগরিক জীবনের উপযোগী করে তোলাই সময়ের দাবী।

দেখা গেছে অধিকাংশ জলাশয়গুলি উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষন ও পরিচর্যার অভাবে দিনে দিনে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কিংবা নোংরা আবর্জনা ফেলতে ফেলতে জলাশয়গুলি আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়ে গেছে। সেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে এক আমূল পরিবর্তনের সাক্ষী রাজধানী আগরতলার নাগরিক সমাজ।

দু-তিন বছর সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েকটি দীঘি বা জলাশয় নতুন সাজে সেজে উঠেছে। আগরতলা শহরের প্রায় হারিয়ে যাওয়া সাতলাখি পুকুর পাড়ের উন্নয়ন ও সৌন্দর্যায়নে নির্মিত পার্কের উদ্বোধন করা হয় ২৩ অক্টোবর, ২০১৯ সালে।

অমৃত (অটল মিশন ফর রিজুভেনেশান এন্ড আরবান ট্রানসফরমেশন) প্রকল্পে এই পুকুরটির উন্নয়ন ও সৌন্দর্যায়নের লক্ষ্যে পার্ক নির্মাণ করা হয়। আগরতলা পুর নিগমের ৩২নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত সাতলাখি পুকুর পাড়ের উন্নয়ন ও সৌন্দর্য্য্যায়নে বায় হয়েছে ১২২ দশমিক ২৬ লক্ষ টাকা। কুমারীটিলা লেইক ও পার্কের উদ্বোধন হয় ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১।

কুমারীটিলা লেইকটি আগে চারদিক থেকে অবৈধভাবে দখলে ছিল। পার্শ্ববর্তী সমস্ত নিকাশী লেইকের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। লেইকের উপরের জায়গাটি পরিবেশ দূষণের অন্যতম উৎস এবং কঠিন বর্জ্য পদার্থের একটি ডাম্পিং সেন্টারে রূপান্তরিত হয়েছিল।

লেইকের চারিদিককে সুসজ্জিতভাবে আলোকিত করা হয়েছে এবং লেইকের মাঝখানে একটি ঝর্ণার আদলে জলধারা বসানো হয়েছে। ১২,২৭৮ বর্গ মিটার আয়তনের এই লেইক ও পার্কের সৌন্দর্যায়নে মোট ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ১৭ লক্ষ ৭৭ হাজার ৪৩৩ টাকা।

চারিদিকে হাঁটাপথের দৈর্ঘ্য ৬২০ মিটার,এল ই ডি লাইটের সংখ্যা ৪৪২টি। সন্ধ্যার পর এক আলোকিত মোহময় পরিবেশ।
আগরতলার বোধজং গালর্স স্কুলের সামনে এবছরের ২১ ফেব্রুয়ারি আগরতলা স্মার্টসিটি মিশনের কর্মসূচিতে একাধিক প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব।

বনমালীপুরে লালাবাহাদুর ক্লাব সংলগ্ন পুরোনো দীঘিটির সংস্কার ও সৌন্দর্যায়নের পর নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এলাকার মানুষ নতুনরূপে এই দীঘিটিকে পেয়ে খুব খুশি। আলোকমালায় সেজে উঠেছে গোটা এলাকা।

মুক্ত বিনোদন ও শরীর চর্চার এটি এখন আদর্শ জায়গা। অনুরূপভাবে মঠ চৌমুহনীর কাছে কামারপুকুর বলে পরিচিত পুকুরটি দীর্ঘদিন অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। এখন যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পুকুরের জলে শোভা পাচ্ছে শাপলা-শালুক। ডিমসাগরের পাড়ে সকাল-সন্ধ্যায় এখন ভ্রমণকারীদের ভীড়।

শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল বয়সের সকলেই শারীরিক কসরৎ, হাটা, ব্যায়াম ও শরীর চর্চা নিয়ে ব্যস্ত। দিনের আলো নিভে গেলে এই জলাশয় ও পার্কটির মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্য সকলকেই হাতছানি দেয়। এম বি বি কলেজের সন্নিকটে তিনটি জলাশয়ের উন্নয়নের কাজ চলছে। খেজুরবাগানস্থিত রাণীর পুকুরটিকেও সাজিয়ে তোলা হয়েছে।

এখন অপেক্ষা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের। চারিদিকে গাছ, হাঁটার ব্যবস্থা, বসার জায়গা, সুদৃশ্য বাধানো ঘাট, ল্যান্ডস্কেপিং, মনোরম আলোকসজ্জা এবং আভিজাত্যতা নিয়ে সাজানো পিলার এই পুকুরটির সার্বিক চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছে। এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৭৪ লক্ষ ৮৭ হাজার ৬০০ টাকা।

প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের জুন মাসে। মুখ্যমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্মার্ট সিটি মিশনের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এই সব প্রকল্পের রূপায়ন একদিকে যেমন পরিবেশকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন করে তুলবে তেমনি বহির্রাজ্যের পর্যটকদের কাছেও এই শহরের কদর বাড়বে।

দীঘিগুলির সংস্কার, সৌন্দর্যায়ন ও বৃক্ষ রোপনের ফলে যান্ত্রিক সভ্যতার যাতাকলে পিষ্ট শহরের নাগরিক সমাজ একটু খোলামেলা পরিসরে এক বুক শ্বাস নেবার জায়গা খুঁজে পেলেন। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রয়োজন নাগরিক সমাজের সহযোগিতা ও সচেতনতা।এই সব সম্পদকে রক্ষা করার জন্য এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের দায়দায়িত্ব ভুলে গেলে চলবে না।

এই শহরকে স্মার্ট করে তুলতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিক হিসাবে আমাদেকেও স্মার্ট ও সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। শুরু হয়েছে রূপায়ন। প্রয়োজন সরকারের পাশে থেকে সেই রূপায়নকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো ও রক্ষণাবেক্ষনের মাধ্যমে নাগরিক দায়দায়িত্ব পালন।

You May Also Like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যাট খুলুন
1
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠান
হেলো, 👋
natun.in আপনাকে কিভাবে সহায়তা করতে পারে?