।। মানিক মালাকার ।। সময়ের সাথে সাথে মানিয়ে নেওয়াই সফল ব্যবস্থাপনার সঠিক দৃষ্টান্ত। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সময়োপযোগী দ্রুত সিদ্ধান্ত এবং সঠিক বাস্তবায়নের চিত্র ফুটে উঠেছে রাজ্যে কোভিড মোকাবিলার ক্ষেত্রে। একথা সবাই জানেন কোভিড সম্পর্কে আগে আমাদের তেমন কোনও ধারণাই ছিলো না। বিশ্বজুড়ে এই অতিমারী মোকাবিলায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছিলো।
এই অবস্থায় গোটা দেশের সঙ্গে অতিমারীর প্রথম ঢেউ এসে পড়ে আমাদের রাজ্যেও। কি সেই রোগ, কিভাবে এর মোকাবিলা করা সম্ভব, কিভাবে মানুষকে সচেতন করা, প্রশাসনিক কি কি ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক, কি ধরনের চিকিৎসা পরিকাঠামো প্রয়োজন এইসব নানা বিষয় নিয়ে সব মহলেই ছিলো জল্পনা ও উদ্বেগ।
একথা সত্যি চিকিৎসক থেকে প্রশাসক কেউ প্রস্তুত ছিলেন না এই কোভিড মোকাবিলার পন্থা পদ্ধতি নিয়ে। ২০২০ সালে কোভিড যখন ধীরে ধীরে বিস্তার শুরু করে তখন সব মহলেই একটা অজানা আতষ্ক ও অচেনা ভয় আচ্ছন্ন করেছিলো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঠিক দিশায় দেশে চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা দ্রুত কার্যকর করা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা শুরু হলো।
পাশাপাশি জনগণকে সচেতন থাকার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর দেখানো পথ ধরেই আমাদের রাজ্যেও কোভিড মোকাবিলায় স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত আমূল পরিবর্তন শুরু হয়। ২০২০ সালে কোভিডের প্রথম ঢেউয়ে রাজ্যে দ্রুত গড়ে উঠে ১টি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল৷
আর ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে ২টি। পাশাপাশি সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কোভিড হাসপাতালে শয্যা সংখ্যাও ২৪০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪১টি। শুধু আগরতলা কেন্দ্রিক চিকিৎসা পরিকাঠামোর সম্প্রসারণ থেমে থাকেনি। আগরতলার পাশাপাশি রাজ্যের অন্যান্য জেলা ও মহকুমায় কোভিড মোকাবিলায় ২০২০ সাল থেকেই ডেডিকেটেড কোভিড হেলথ সেন্টার ও কোভিড কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর।
২০২০ এবং ২০২১ সালের তুলনামূলক পরিসংখ্যান দেখলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। রাজ্যে ২০২০ সালে ৭টি ডেডিকেটেড কোভিড হেলথ সেন্টার ছিলো। ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত তা দাঁড়ায় ১৪টিতে৷ অর্থাৎ এক বছরে একেবারে দ্বিগুণ বেড়েছে শয্যার সংখ্যাও। গতবছর রাজ্যে কোভিড কেয়ার সেন্টার ছিলো ২১টি। এবছর এখন পর্যন্ত বেড়ে হয়েছে ২৯টি।
কোভিড মোকাবিলায় জেলা ও মহকুমায় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে আইসোলেশন বেড়, অক্সিজেন যুক্ত শয্যা এবং আইসিইউ শয্যার সংখ্যাও। কোভিড অতিমারী মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের বিশেষ উদ্যোগের প্রমাণ মেলে এইসব পদক্ষেপের মাধ্যমে। কোভিড মোকাবিলায় প্রথম ধাপে প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর, বিএলএস অ্যাম্বুলেন্স সহ অক্সিজেন প্ল্যান্টের অপ্রতুলতা ছিলো।
কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তার কথা বরাবর উপলব্ধ হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অক্সিজেনের অভাবে কোভিড আক্রান্ত কোনও রোগীর যাতে মৃত্যু না হয় সে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে রাজ্যে অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের উপর গুরুত্ব দেয় সরকার। বর্তমানে রাজ্যে ৩টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট রয়েছে। আরও ১৫টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর কাজ চলছে।
রাজ্যের ৮টি জেলায় ৮টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের পাশাপাশি জিবি হাসপাতালে ৯০০ এলপিএম এবং আইজিএম হাসপাতালে ১,০৫০ এলপিএম অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ চলছে। আইজিএম হাসপাতালে যে অক্সিজেন প্ল্যান্টটি স্থাপন করা হচ্ছে তা হবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সর্ববৃহৎ অক্সিজেন প্ল্যান্ট। পাশাপাশি কোভিড মোকাবিলা করার জন্য রাজ্যে বর্তমানে ১,২৫০টি অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর রয়েছে।
আরও ১,০০০টি অক্সিজেন কনসেন্টেটরের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ডোনেশন হিসেবে ভারত সরকারের কাছ থেকে ৩৫০টি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে ১০০টি অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর পাওয়া গেছে। কোভিড চিকিৎসা মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের তৎপরতায় আইসোলেশন বেডের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
২০২০ সালে রাজ্যে যেখানে ২,৮১২টি আইসোলেশন বেড ছিলো ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩,৫২৯টি। অক্সিজেনযুক্ত শয্যা ২০২০ সালে ছিলো ৩৯২টি। ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত তা বাড়িয়ে ১,০২৮টি করা হয়েছে। আইসিইউ শয্যা ২০২০ সালে যেখানে ছিলো ১৬টি তা বর্তমানে বাড়িয়ে ৮২টি করা হয়েছে।
কোভিড রোগীর চিকিৎসায় শয্যার সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি ভেন্টিলেটরের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। ২০২০ সালে রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালগুলির জন্য মাত্র ৪টি ভেন্টিলেটর ছিলো। কোভিড চিকিৎসায় ভেন্টিলেটরের গুরুত্ব অনুধাবন করে খুব দ্রুতই তা বাড়িয়ে বর্তমানে ১৮৬টি করা হয়েছে। বিএলএস অ্যাম্বুলেন্স রাজ্যে বর্তমানে ৬১টি রয়েছে।
এরকম আরও ২৬টি অ্যাম্বুলেন্স ডোনার ফান্ড থেকে কেনার জন্য প্রক্রিয়া চলছে। এক কথায় বলা যায়, স্বাস্থ্য পরিষেবায় যা এতোকাল আমাদের ছিলো না কিংবা যেসব ক্ষেত্রে স্বল্পতা ছিলো সেক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই মজবুত হয়েছি। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বিকেন্দ্রীকরণ করেই কোভিড অতিমারী মোকাবিলায় সাফল্য এসেছে।
প্রায় প্রস্তুতিহীনভাবে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো সেই যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা খুব কম সময়ের মধ্যেই নিজেদেরকে প্রস্তুত করে নিতে পেরেছি আজ এই তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে অন্তত সেই কথা বলা যেতেই পারে। মুখ্যমন্ত্রীর নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ফলেই সময়ের কালক্ষেপ না করে কোভিড মোকাবিলায় চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে দ্রুত নতুন নতুন বিষয়ের সংযোজন সম্ভব হয়েছে।
এতে চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীগণ যেমন সঠিক চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আশ্বস্ত হয়েছেন তেমনি রাজ্যের মানুষও ভরসা পেয়েছেন কোভিড যুদ্ধে জয়ী হওয়ার। যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে শুরু হয়েছিলো সেই জায়গায় রাজ্যবাসী একটা বিশ্বাসের ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন। এটাই পরিবর্তন। আর আমরা সেই পরিবর্তনের সহযাত্রী।