।। বর্ষা দেবনাথ।। আগরতলা।। ঘুম থেকে উঠেই রিয়ার ইচ্ছা হল সে আজ শাড়ি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। প্রথমেই ভাবলো, কিছুই তো গুছিয়ে রাখেনি। এখন শাড়ির পরার ঝামেলায় যাওয়া কি ঠিক হবে? রিয়ার মত অনেকেরই শাড়ি পরার কথা মাথায় আসলেই সবার আগে মাথায় আসে ‘ঝামেলা’ শব্দটা। শাড়ি মানে ঝামেলা কারণ, শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ লাগে, সাজগোজ লাগে, গয়না লাগে, টিপটপ চুল লাগে, লাগে হিল জুতো। কিন্তু শাড়িকে ঝামেলা মনে করার সেই দিন আর নাই।
এখন কর্মজীবনে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ার সাথে সাথে বদলে গেছে মেয়েদের সাজপোশাকের ধরণ। ব্যস্ত জীবনে এখন স্বাচ্ছন্দ্য আর ঝামেলামুক্ত এই দুই প্রাধান্য পায় আজকের মেয়েদের সাজপোশাকে। রিয়া কিংবা রিয়ার মত আরও অনেকেই তাই আর শাড়ি পরার ইচ্ছা হলে আঁতকে ওঠে না। শাড়িতে মাড় কিংবা ইস্তিরি আছে কিনা, ম্যাচিং ব্লাউজ আছে কি নাই তা নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করে না। বাজার থেকে কেনা কিংব মায়ের আলমারি থেকে নেওয়া ইলফিটেড (মাপ ঠিকমত না হওয়া) একটা ব্লাউজ নাহয়, ক্রপ টপ, কিংবা নিতান্ত সাধারণ একটা টপস দিয়েই পরে ফেলছে শাড়ি।
শাড়ির সাথে ম্যাচিং চুড়ি, ব্যাগ, হিলজুতোর ঝামেলাতেও যাচ্ছেন না অনেকে। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে গয়না যে কেউ পরেন না, তা নয়। তবে হাতে সময় না থাকলে সেটাও এড়িয়ে যান অনেকেই। শাড়ির সাথে চুলে খোঁপা, হাতে চুড়িও আর এখন কোন আবশ্যকীয় বিষয় নয়। নাকে একটা নথ আর একটা চামড়ার চটি, ব্যাস এটুকুতেই পুরো হচ্ছে অনেকের সাজ।
কেউ কেউ শুধুমাত্র কানে দুল পরে আবার কেউ গলায় শাড়ির সাথে রং মিলিয়ে কিংবা না মিলিয়ে মালা পরেন আবার কেউ বেছে নেন বড় আকারের কাঠ, পাথর কিংবা পাথরের আংটি। এমনকি একগাদা পিন দিয়ে পরিপাটি ভাঁজে শাড়ি পরার চলনও অনেকটাই কমে গিয়েছে। এখন মেয়েরা একটা পিন দিয়ে আঁচল আটকে বা পিন ছাড়াই শাড়ি পরে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার শাড়ি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে বৈচিত্র্য। আরামদায়ক নরম দেশি শাড়ির দিকেই ঝোঁক বেশি আজকালকার মেয়েদের।
শাড়িতেও এসেছে নানারকম ডিজাইন বৈচিত্র্য। ব্লক বাটিক তো ছিলই এখন শাড়িতে চলছে হ্যান্ড পেইন্টের চলন। শাড়ি হয়ে উঠেছে ব্যক্তিত্ব প্রকাশের মাধ্যম। শাড়ির ক্যানভাসে উঠে আসছে গান কিংবা কবিতা। কখনও আবার প্রখ্যাত ব্যক্তিদের মুখায়বয়ব। শুধু শাড়িতেই নয়, ফ্যাশনটাকে নিজের মত করে সংজ্ঞায়িত করার এই ধারা চলছে যেকোন সাজপোশাকেই।
শাড়ি হোক কি কামিজ, টপস বা শার্ট, প্যান্ট কি স্কার্ট কেউ যেন আর কেউ নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে ইচ্ছুক নয়। ফ্যাশন এখন অনেকটাই ব্যাক্তিগত পছন্দ অপছন্দের উপর নির্ভর করে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ট্রেন্ডের সাথেও তাল মিলিয়ে চলেন আজকের মেয়েরা। তাই পোশাকে এবং সাজগোজে মিক্স এন্ড ম্যাচের একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
মিক্স এন্ড ম্যাচ সবচাইতে বেশি দেখা যায় প্যান্ট, শার্ট এবং টি –শার্টের ব্যাবহারে। টি- শার্ট কিংবা শার্টের সাথে প্যান্ট কিংবা ট্রাউজার না পরে পড়ছেন হেরেম প্যান্ট কিংবা পালাজো। হাতে পরছেন রঙ বেরঙের কাঠ, পুঁতি, মাটি কিংবা তামার ব্রেসলেট, নাকে নথ, কপালে টিপ। স্কার্ফ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন গামছা। সেই স্কার্ফও কেউ কেউ গলায় না ঝুলিয়ে পাগড়ির মত করে মাথায় পেঁচিয়ে রাখেন। নিজের নিয়মে চলাটাই এখন ফ্যাশন। গামছা শুধুমাত্র স্কার্ফ হিসেবেই ব্যাবহৃত হচ্ছে তা না।
গামছা দিয়ে বানানো হচ্ছে ব্লাউজ, ফতুয়া কিংবা টপস যার শুরুটা করেছিলেন প্রখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল। আধুনিক জীবনের গতির সাথে তাল মেলানোর জন্য আজকের মেয়েদের ছুটতে হয় নিরন্তর। হাঁটতে হয় মাইলের পর মাইল রাস্তা, ছুটে গিয়ে উঠতে হয় পাবলিক বাসে কিংবা ট্রেনে। এইসব বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই পোশাকের পাশাপাশি জুতা বাছাই করতেও আরামের দিকটা মাথায় রাখছেন আজকের নারীরা।
স্বাচ্ছন্দ্য এবং ব্যবহারের সুবিধার জন্য স্নিকার্স তাই এখন দারুণ জনপ্রিয়। শুধুমাত্র জিনসের সাথেই নয়, লেগিনস, সালোয়ার কামিজ কিংবা শাড়ির সাথেও অনেকে স্নিকার্স পরেন। বাঙালি নারী মানেই দীঘল কালো চুল নয়। বেশ কয়েকবছর ধরে জনপ্রিয় ব্রাউনের নানা শেডের পাশাপাশি মেয়েরা এখন লাল, নীল, ধূসর, সবুজ, বেগুনী নানা রঙে চুল রাঙাচ্ছেন। চুলের রঙেই যেন ফুটে উঠছে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।
পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা কিংবা কোন কাজেই আর পিছিয়ে থাকতে রাজি নয় আজকের নারী। তাই সাজগোজের জন্যও সময় নষ্ট করতে রাজী নয় তারা। কিন্তু তবুও কিছুটা সাজলে নারীত্বের অন্যরকম সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। আধুনিক বাঙালি নারীর ক্ষেত্রে একটা সাজেরই কোন বদল আসেনি আর তা হল চোখের কাজল। অনেকেরই জন্যই এই সাজটা না হলে চলেই না। নানা রঙের কাজল চললেও এখনও বেশিরভাগ মেয়ে কালো কাজলেই চোখ সাজান। গয়না বাছাইতেও প্রাধান্য পাচ্ছে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া।
পোশাকভেদে নানা রঙের এবং ম্যাটেরিয়ালের গয়না পরছেন মেয়েরা। কাঠ, মাটি, কড়ি, পুঁতি, পাট, তামা নানারকম বীজের তৈরি বড় কিংবা ছোট মালা, চুড়ি, কানের দুল আর আংটি জনপ্রিয় তরুণীদের মাঝে। এসব গয়নার আকৃতিতে মানা হচ্ছেনা নির্দিষ্ট কোন নিয়ম। যার যেরকম ভালো লাগে সে সেভাবেই ব্যবহার করছে। কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে নথ পরার চলন। কেউ একটা নথ পরছেন কেউ বা বেছে নিচ্ছেন একের অধিক নথ।
জনপ্রিয় আর্ট ফর্ম অ্যাভান্ট গার্ডের নিদর্শন দেখা যায় সঙ্গিত থেকে শুরু করে পোশাক এবং গয়নার ডিজাইনে। এর মানে হল সেইসব ব্যক্তি কিংবা তাদের কাজ যারা একই সাথে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করে, গোঁড়ামুক্ত আবার যারা একইসাথে সমাজ, সংস্কৃতি এবং আর্টের মূলভাবও ধরে রাখে। আধুনিক বাঙালি নারীর সাজ পোশাকে সেই নিরীক্ষাই যেন চোখে পড়ে।