স্টাফ রিপোর্টার, আগরতলা, ১৫ আগস্ট।। সমগ্র দেশের পাশাপাশি রাজ্যেও যথাযোগ্য মর্যাদার সহিত পালিত হল ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবস। রাজ্যের মূল অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় আসামরাইফেল ময়দানে। সেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষে পরিবেশন করা হয় জাতীয় সঙ্গীত। তারপর প্যারেড প্রদর্শন করা হয়। তবে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারনে এই বছর প্যারেড প্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্লেটুনের সংখ্যা কমিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এমনকি অন্যান্য বছরের ন্যায় কুচকাওয়াজও প্রদর্শন করা হয়নি। জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর অন্যান্য বছরের ন্যায় হুড খোলা গাড়িতে করে প্যারেড ঘুরে দেখেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। পরে তিনি রাজ্যবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। রাজ্য বাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যবাসিকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন করোনা পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার ২ হাজার ১২৯ টি শয্যার ব্যবস্থা করেছে। রাজ্য জুড়ে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা করা হয়েছে। RTPCR ও এন্টিজেন টেস্টের জন্য সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২৭ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি স্বাস্থ্য সমীক্ষা ও রোগী শনাক্ত করণের কাজ করা হয়েছে।
প্রায় ১২ হাজার কর্মী এই কর্মজজ্ঞে নিয়োজিত ছিল। মাত্র ৭ দিনে ৯ লক্ষ ৫৬ হাজার পরিবারের সার্ভে সম্পন্ন হয়েছে। ত্রিপুরা একমাত্র রাজ্য যেখানে এই ধরনের সার্ভে করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন প্যাকেজ চালু করে দেশের নাগরিকদের জীবন যাত্রাকে সচল রাখার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় রাখার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। সকলের নিকট আত্ম নির্ভর ভারত গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি চালু করা হয়েছে। এই শিক্ষা নীতি অত্যন্ত সময়োপযোগী। এটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, দেশের মানুষের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে চলেছে। ভারতের বিদেশ নীতি বর্তমানে সর্বস্তরে উচ্চ প্রশংসিত। দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ বর্তমানে সংকল্পবদ্ধ বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব।বর্তমান রাজ্য সরকারের অগ্রাধিকার ক্ষেত্র গুলির মধ্যে রয়েছে কৃষি, কৃষকের উন্নতি, রাজ্যের বাঁশ, রাবার ও চা-কে কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে স্বনির্ভরতা সৃষ্টি করা।
রাজ্যের আর্থিক বুনিয়াদকে শক্তিশালী করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার করে আত্ম নির্ভর রাজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প জারি রয়েছে। রাজ্য সরকার প্রতিটি বাড়িতে গুনমান সম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে দায়বদ্ধ। নিরবচ্ছিন বিদ্যুৎ পরিষেবা প্রদানের লক্ষ্যে স্মার্ট কল সেন্টার চালু করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে ২০১৭ সালের পর এই প্রথম সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পরিষেবা পৌঁছে দিতে সৌভাগ্য প্রকল্প চালু করা হয়েছে। সকলকে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানের জন্য রাজ্য সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও তার জন্য পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য রাজ্য সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা অব্যাহত রয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। চিকিৎসা পরিষেবার উন্নতি করার ফলে গত ৫ বছরে রাজ্য থেকে বহিঃরাজ্যে রোগী রেফারের হার কমেছে। রাজ্যে দুই বছরের মধ্যে নিউরো সার্জারি করা হয়েছে ৩০০ টি। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের আওতায় একজন রোগী ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সুবিধা পেতে পারে।
আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প ও প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনায় এই বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত রাজ্যে ১১ লক্ষ ৪৫ হাজার ৫১০ টি কার্ড প্রদান করা হয়েছে। যারা এই প্রকল্পের আওতায় আসবে না তাদের আয়ুষ্মান ত্রিপুরা প্রকল্পের আওতায় আনা হবে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব।শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রেও রাজ্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রথম রাজ্যে NCERT-পাঠক্রম চালু করা হয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ করানো হয়েছে। নতুন দিশা নামে নতুন প্রকল্প চালু করা হয়েছে। মাধ্যমিকের ৩০ জন কৃতি ছাত্র-ছাত্রীকে সুপার-৩০ প্রকল্পে বহিঃরাজ্যে বিশেষ কোচিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাজ্যের ২০ টি সরকারী বিদ্যালয়কে CBSE বোর্ডের আওতায় নিয়ে আশা হয়েছে। প্রতি বছর মেধাবী ছাত্রী ছাত্রীদের মুখ্যমন্ত্রী মেরিট এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হচ্ছে। রাজ্যের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্য, তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য লক্ষ নামে প্রকল্প চালু করা হয়েছে। রাজ্যের ২২ টি সাধারন ডিগ্রি কলেজে অনলাইনে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। ঘরে ঘরে জল পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে রাজ্য সরকার অটল জলধারা প্রকল্প রুপায়ন করেছে।
এখনো পর্যন্ত ১ লক্ষ ৭৮ হাজার ৯২৩ টি পরিবারকে পানীয় জলের সংযোগ প্রদান করা হয়েছে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরও জানান রাজ্যে ই-পরিষেবা প্রদানের কাজ শুরু হয়েগেছে। এখনো পর্যন্ত ৮০ টি ক্ষেত্রে ই-পরিষেবা প্রদান শুরু হয়েগেছে। ২০১৭-১৮ সালের তুলনায় ২০১৯-২০ সালে রেগার স্রমদিবস বৃদ্ধির হার ৯৫ শতাংশ। ২০২০-২১ সালে ৪ কোটি স্রমদিবস সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
এই বছরের ১০ আগস্ট পর্যন্ত ১ কোটি ৩৮ লক্ষ্য স্রমদিবস ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনায় ৩ বছরে ২৩ হাজার ২৩০ জনকে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সেক্টরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ৬ হাজারেরও বেশি বেকার যুবক-যুবতী রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে। রাজ্যের প্রতিটি পরিবারকে ফেমিলি বেনিফিট রিপোর্ট কার্ড প্রদানের পরিকল্পনা রাজ্য সরকারের রয়েছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরও জানান এই কার্ডে লেখা থাকবে ২০১৮-১৯ অর্থ বর্ষ থেকে ঐ পরিবার কি কি সুযোগ সুবিধা পেয়েছে।
উপাজতিদের জীবন মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে রাজ্য সরকার। টিটিএএডিসির নামকরণ “তিপ্রা টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল” করার জন্য রাজ্য মন্ত্রী সভার কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট পাঠানো হয়েছে। টিটিএএডিসির আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই আগরতলায় একটি ট্রাইবেল গেষ্ট হাউস নির্মাণের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। দুইটি ট্রাইবেল রেস্ট হাউস নির্মাণের কাজ চলছে।
সেই সঙ্গে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে আগরতলায় একটি ট্রাইবেল গেষ্ট হাউস নির্মাণের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।”পোষণ অভিযান” কর্মসূচী এবং “প্রধানমন্ত্রী মাত্রু বন্দনা” যোজনার বাস্তবায়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। “পোষণ অভিযান” কর্মসূচীতে আইসিডিএসের সুপারভাইজার সহ অঙ্গনওয়ারী কর্মীদের ১০ হাজার ৭৩৫ টি স্মার্ট ফোন ইতিমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। “প্রধানমন্ত্রী মাত্রু বন্দনা” যোজনার আওতায় ৬০ হাজার ৮৮৬ জনকে আনা হয়েছে। এছাড়াও বর্তমান রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার কি কি কাজ করছে তার খতিয়ান তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। রাজ্যবাসীর উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের পর ভার্চুয়াল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয় আসামরাইফেল ময়দানে।
এইদিনের রাজ্য ভিত্তিক অনুষ্ঠানে কর্মক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বেশ কয়েকজন আরক্ষা কর্মীকে মেডেল প্রদান করা হয়। তাদের মেডেল পরিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। এইদিনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সাংসদ প্রতিমা ভৌমিক, রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত মহানির্দেশক রাজীব সিং, রাজ্যের এডভোকেট জেনারেল অরুন কান্তি ভৌমিক সহ অন্যান্য প্রশাসনিক আধিকারিকরা।